নড়াইলের চিত্রা পাড়ের জেলে পরিবারের নিয়মিত সদস্য ভোঁদর!-একুশে মিডিয়া - Ekushey Media bangla newspaper

Breaking News

Home Top Ad

এইখানেই আপনার বা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ: 01915-392400

নিউজের উপরে বিজ্ঞাপন

Sunday, 2 December 2018

নড়াইলের চিত্রা পাড়ের জেলে পরিবারের নিয়মিত সদস্য ভোঁদর!-একুশে মিডিয়া


উজ্জ্বল রায়, নড়াইল জেলা প্রতিনিধি■:
আয় রে আয় টিয়ে নায়ে ভরা দিয়ে না নিয়ে গেল বোয়াল মাছে। তা দেখে দেখে ভোঁদর নাচে ওরে ভোঁদর ফিরে চা। খোকার নাচন দেখে যা সেই খরস্রোতা চিত্রা নদী আর নেই, শহরের পাশ ঘেঁষে বয়ে চলা এই নদীর দু’কূল চিত্র বা ছবির মতো সাজানো আর সুন্দর ছিলো বলেই এই নদীর নাম হয়েছে এই চিত্রা। চিত্রা নদীর নাম নিয়ে এমন জনশ্রুতি শোনা যায় মানুষের মুখে মুখে।
১৯৪৭ সালের ভারতভাগের প্রেক্ষাপটে নির্মিত তানভীর মোকাম্মেলের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’র সেই চিত্রাও আর নেই।
তৌকির আহমেদ আর আফসানা মিমির মত আজ আর কেউ হয়তো সেই নদীর পারে আড্ডা দেয় না। সময়ের ফেরে নদীর পারে গড়ে উঠছে বহুতল ভবন। দূষণের করাল গ্রাস আর স্রোতের গতিপথে বাধা দিয়ে স্থাপনা নির্মাণ করে স্থানে স্থানে নৌকা চলাচলের মত নাব্যতাও হারিয়েছে চিত্রা। কিন্তু সময়ের সাথে যুদ্ধ করে টিকে আছে চিত্রা পাড়ের সংগ্রামী ভোঁদর জেলে! চিত্রা পাড়ের সংগ্রামী জেলেদের ভোঁদর; চিত্রার পাড়ের নড়াইল জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম ভোগরা, গোয়ালবাড়ি, রতডাঙ্গা, পঙ্কবিলাস আর গোয়ালবাড়ির জেলেরা আজও ভোঁদর ব্যবহার করে মাছ ধরেন।
প্রাকৃতিকভাবে নড়াইল ছাড়াও খুলনা, সিলেট এবং পাবর্ত্য অঞ্চলে ভোঁদর পাওয়া যায়।

বাংলাদেশে মোট ৩ প্রজাতির ভোঁদর পাওয়া যায়, যাদের বেশীরভাগই বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু কেন? ভোঁদরের প্রিয় খাদ্য মাছ। তবে মাছ ছাড়াও বিভিন্ন জলজ প্রাণী শিকারে পটু ভোঁদর। বসবাস জলাশয়ের পাশে বনজঙ্গলে। জলাশয়ের গতিপথ পরিবর্তন, বনজঙ্গল ধ্বংস করে নদীর পারে বসতি নির্মাণ, কারেন্ট জালে মাছ শিকারের সময় ধরা পড়া ভোঁদড় মেরে ফেলার ফলে ভোঁদরের সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে কমে আসছে।
বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রাণীটিকে সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষণা করা হলেও স্থানীয় মানুষের নানা কুসংস্কার আর অসচেতনতার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে এই প্রাণীটি। পুকুরের মাছ খেয়ে ফেলবে এই ভয়ে অনেকেই লোকালয়ের আশেপাশের ভোঁদর মেরে ফেলতে উদ্যত হোন। অনেক চক্র আবার ভোঁদরের চামড়ার ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের নড়াইলের চিত্রা নদীর পাড়ের জেলেরা শত বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখে পালন করে যাচ্ছেন ভোঁদর। বন্যপ্রাণী আইনে ভোঁদর একটি সংরক্ষিত প্রাণী.পড়স মূলত পোষা ভোঁদরের সাহায্যে তারা মাছ শিকার করেন।
পাশাপাশি ভোঁদরের মত একটি বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীকে সংরক্ষণেও তাদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু ভোঁদর ব্যবহার করে মাছ ধরা হয় কীভাবে? মোটামুটি দু’শ বছরের বেশী সময় ধরে বাংলাদেশের নড়াইল এবং সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় মাছ ধরার কাজে ভোঁদর ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে তিনটি প্রজাতির মধ্যে নামের প্রজাতিটি মাছ শিকারে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে সবচেয়ে বেশী দেখা যায় প্রজাতির ভোঁদরগুলো প্রভুভক্ত এই স্তন্যপায়ী প্রানী দেখতে অনেকটা বিড়ালের মত। তবে এই প্রাণীকে মাছ ধরতে নামানোর আগে প্রশিক্ষণ দিয়ে নেওয়া হয়।
প্রশিক্ষিত ভোঁদর জাল থেকে মাছ খায় না। বরং মাছের ঝাঁককে তাড়িয়ে জালের দিকে নিয়ে আসে।পুকুর, বিল কিংবা খরস্রোতা নদীতে দক্ষভাবে মাছ ধরতে পারে। ভোঁদর ব্যবহার করে মাছ শিকার নড়াইল, খুলনা আর সুন্দরবন এলাকাতেই সীমাবদ্ধ; অক্টোবর থেকে জানুয়ারী, এই সময়ে নড়াইল, খুলনা সহ সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার জেলেরা ভোঁদর ব্যবহার করে নদী থেকে মাছ ধরেন। মাছ ধরার জন্য জেলেরা সাধারণত দলে ভাগ হয়ে নেন। প্রতিটি দলে তিন থেকে পাঁচজন জেলে, একটি জাল এবং কম পক্ষে তিনটি ভোঁদর ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্রতিটি দলে দুটি পুর্ণবয়স্ক এবং একটি কমবয়সী ভোঁদর থাকে। ভোঁদর ব্যবহার করে মাছ ধরার মূল কৌশল; প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বয়স্ক ভোঁদর দুটিকে সাধারণত খুঁটির সাথে দড়িতে বেঁধে ছেড়ে দেওয়া হয়। কমবয়সী ভোঁদরটিকে মুক্ত অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে মূলত একটি ত্রিভুজাকৃতি ক্ষেত্র তৈরী করা হয়। বয়স্ক ভোঁদর দুটিকে দড়ির মাধ্যমে সময়ে সময়ে টান দিয়ে তাড়া দেওয়া হয়, ফলে এরা মাছের ঝাঁককে জালের দিকে তাড়া করে। মাছ ধরা শেষ হওয়ার পরে জাল গুটিয়ে নেওয়া হয়, পাশাপাশি দড়ি ধরে ভোঁদরগুলোকেও নৌকায় নিয়ে আসা হয়।
শিক্ষানবিশ ছোট ভোঁদরটিকেও টোপ দিয়ে তুলে আনা হয়। এভাবে শিক্ষানবিশ ভোঁদরটিকে বেশ কয়েকবার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মাছ ধরা শেষ হওয়ার পরে তুলে আনা হয় ভোঁদরকে মাছ ধরে আনার পরে পুরষ্কার হিসেবে ছোট ছোট মাছ ভোঁদরদের দিয়ে দেওয়া হয়। মূলত এর মাধ্যমেই ভোঁদরগুলো মানুষের প্রতি সহনশীল হয়ে উঠে। সহজ কথায়, এভাবেই বন্য ভোঁদর ধীরে ধীরে পোষ মানানো হয়।
পুরষ্কার হিসেবে ছোটমাছ যায় ভোঁদরের পেটে  পরিবারের সদস্য যখন ভোঁদর নড়াইলের অনেক জেলে পরিবারের নিয়মিত সদস্য প্রাণীটি। জলাশয়গুলোতে মাছ কমে আসার ফলে বংশানুক্রমে ভোঁদর পালন করে আসা জেলে পরিবারগুলোতে এখন বাজছে বিচ্ছেদের সুর।
জলাশয়গুলোতে কমে আসছে মাছ; অনেকেই পেশা বদলাচ্ছেন। অনেকেই পরিবার ভোঁদর পালনের অতিরিক্ত খরচ বহন করতে না পেরে বিক্রি করে দিচ্ছেন। বিলুপ্তপ্রায় এই প্রাণীর চামড়ার মূল্য অনেক বেশী হওয়ায় পাচারকারী চক্র বেশ সজাগ দৃষ্টি রাখে জেলেদের উপর। জেলেদের অনেকেই তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা মূল্যে বিক্রি করে দেন ভোঁদর।
সুন্দরবন এলাকায় জলদস্যুর উৎপাত বেড়ে যাওয়ায় জেলেদের অনেকেই মাছ ধরে পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। জেলেদের পেশা বদলের সাথে সাথে এই প্রাণীগুলোর বিলুপ্তির আশঙ্কাও বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে। প্রজনন একেকটি ভোঁদর বেঁচে থাকে প্রায় ২০ বছর। দেখতে অনেকটা বিড়ালের মত এই প্রাণী ওজনে ৩ থেকে ৪ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। স্ত্রী ভোঁদর প্রতি বছরে একবার তিন থেকে চারটি বাচ্চা প্রসব করে।
বেশ দীর্ঘ আয়ুর অধিকারী হয় একেকটি ভোঁদর;  সংরক্ষণ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা সম্পর্কিত একটি আইন ২০১২ সালে পাস হয়েছে। এই আইনে বলা হয়েছে, “এই আইনটি পাস হওয়ার ১৮০ দিনের মধ্যে কোনো ব্যক্তির কাছে সংগৃহীত ও সংরক্ষিত কোনো বন্য প্রাণী থাকলে সেগুলো নিবন্ধনের আওতাভুক্ত করতে হবে। ভোঁদর সংরক্ষণে জোর উদ্যোগ নেওয়ার সময় এখনই কিন্তু সেই আইনে প্রাণী সংরক্ষণের উপর তেমন জোর দেওয়া হয়নি।
পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলের জেলেদের বেশীরভাগই এই নিবন্ধন কার্যক্রমের সাথে মোটেই পরিচিত না হওয়ায় এই এলাকায় কী পরিমাণ ভোঁদর আছে তার কোনো রেকর্ডও নেই। তাই এই বন্যপ্রাণীটি অবহেলা আর অনাদরেই থকে যাচ্ছে। তবে আশার কথা হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক এবং গবেষক ভোঁদরের প্রজনন, বিস্তার এবং সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ, সাজেদা বেগম এবং মোহাম্মদ কামরুল হাসানের গবেষণা থেকে উঠে এসেছে কীভাবে ভোঁদর দিয়ে মাছ শিকার করা জেলেরা বিলুপ্তপ্রায় এই প্রাণীর সংরক্ষণে নীরব ভূমিকা রেখে চলেছেন। তাদের গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয়েছে জেলেদের পোষা ভোঁদরগুলো বন্য পরিবেশেও বেঁচে থাকতে পারে।
সুতরাং যদি কৃত্রিমভাবে প্রজননকৃত ভোঁদরের একটি অংশকে প্রাকৃতিক পরিবেশে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে একদিকে যেমন ভোঁদরটিকে তার যথাযথ প্রাকৃতিক পরিবেশে সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে, অন্যদিকে ভোঁদর পালন এবং এটি ব্যবহার করে মাছ ধরার মাধ্যমে একে তার বন্য পরিবেশের বাইরেও সংরক্ষণ (ex-situ conservation) করা সম্ভব হবে। আর তা যদি এখনই সম্ভব না হয়, তাহলে হয়তো রবীন্দ্রনাথের ছেলেভোলানো ছড়ার সেই ভোঁদর প্রাণীটির নাচন নতুন প্রজন্মের কাছে অজানাই থেকে যাবে। আয় রে আয় টিয়ে নায়ে ভরা দিয়ে না নিয়ে গেল বোয়াল মাছে। তা দেখে দেখে ভোঁদর নাচে ওরে ভোঁদর ফিরে চা। খোকার নাচন দেখে যা।



একুশে মিডিয়া/এমএসএ

No comments:

Post a Comment

নিউজের নীচে। বিজ্ঞাপনের জন্য খালী আছে

Pages