একুশে মিডিয়া, মতামত প্রতিবেদন:
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কয়েকদিন আগে প্রতিষ্ঠার ৬৯তম বছর পার করে ৭০ বছরে পদার্পণ করেছে। আওয়ামী লীগ শুধু একটি নাম একটি প্রতিষ্ঠানই নয়, অসংখ্য ইতিহাস এই নামের সাথে গাঁথা। এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস মানে আওয়ামী লীগ। এছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সকল আন্দলনের ধারক ও বাহক আওয়ামী লীগ। সচেতন ব্যক্তিমাত্রই একবাক্যে স্বীকার করবেন বাংলাদেশে সফল ও বৃহৎ রাজনৈতিক দল মানেই আওয়ামী লীগ। এই দলটির বিরুদ্ধে ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হয়েছে ২১ বছর। দলকে নিশ্চিহ্ন করতে বারবার চেষ্টা করেছে পঁচাত্তরের ঘাতক ও একাত্তরের পরাজিত শক্তি। তবুও দলটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য কোনো দলের বিরুদ্ধে যদি এমন লাগাতার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চলতো তাহলে তাদের অস্তত্বি থাকত কিনা সন্দেহ। অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করেই দলটিকে আজকের পর্যায়ে আসতে হয়েছে।
কেবল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসই নয়, আওয়ামী লীগের পথকে রুদ্ধ করতে কালে কালে বহু ষড়যন্ত্র হয়েছে। বহু অপপ্রচারের বিষবাষ্প জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অনেকে মিথ্যাচার করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ঘাতকরা দলকে নিশ্চিহ্ন করতে প্রথমেই অস্ত্র হিসেবে নিল ধর্মকে। সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মহীনতা বলে প্রচার করা হল। এরপর শুরু হল জাতির জনকের পরিবারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার। এই অপপ্রচার যাকে নিয়ে বেশি করা হয়েছে তিনি শেখ কামাল। উদ্দেশ্য বঙ্গবন্ধু পরিবারের নামে বিদ্বেষ ছড়ানো ও ঘৃণা উৎপাদন করা। ফলে শেখ কামালকে নিয়ে জঘন্যরকমের মিথ্যাচার ও অপপ্রচার করা হলো। অথচ শেখ কামাল ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতিকর্মী, শিল্পী ও ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলাদেশ আবাহনী ক্রীড়াচক্রের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর স্ত্রী সুলতানা রোজীও একজন ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব। বঙ্গবন্ধু পুত্র হয়েও তিনি খুব সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। বাংলাদেশে আর কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের সন্তান এত সাধারণ জীবনযাপন করেননি। অথচ তাঁর নামেই অপপ্রচার করা হলো তিনি ব্যাংক ডাকাতি করেছেন।
গুজব ছড়ানো হলো, ১৯৭৩ সালের বিজয় দিবসের আগের রাতে শেখ কামাল ব্যাংক ডাকাতি করে পালাতে গিয়ে পুলিশের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তার সঙ্গীদেরও পুলিশ আটক করেছে। বঙ্গবন্ধুর ছেলে বলে পরে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এভাবে একটি মিথ্যা গল্প বানানো হয় এবং সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া হয়। অথচ মূল ঘটনা হলো, সর্বহারা পার্টির সিরাজ শিকাদার ঢাকায় হামলা চালাতে পারে এমন সন্দেহে পুলিশ সেদিন সাদা পোশাকে সতর্ক টহল দিচ্ছিল। ওদিকে রাতে শেখ কামাল খবর পান সর্বহারা পার্টির ক্যাডাররা মতিঝিল ব্যাংক লুট করতে পারে। খবরটি শুনেই তিনি তৎকালিন ঢাকার পুলিশ সুপার মাহবুব আলম বীরবিক্রমকে অবহিত করেন। দুষ্কৃতিকারীদের ধরার জন্য তিনি নিজেও গাড়িতে করে তার বন্ধুদের নিয়ে ছুটে যান। অন্যদিকে পুলিশ শেখ কামালদের গাড়িকে সর্বহারা পার্টির সদস্য মনে করে অতর্কিতভাবে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। এতে গাড়িতে থাকা শেখ কামালসহ প্রায় সকলেই আহত হন।
অবশ্য কিছুক্ষণ পর পুলিশের ভুল ভাঙে এবং দ্রুত আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেদিন শেখ কামালের সাথে বিএনপি নেতা ইকবাল হাসান টুকু, জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ, কামালের বন্ধু আবুল ফজল মোহাম্মদ আবদুল হান্নানও ছিলেন। আবুল ফজল মোহাম্মদ আবদুল হান্নান আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এনাকে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সেদিন পুলিশের সাথে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল। পুলিশ তাদেরকে সর্বহারা পার্টির সদস্য মনে করে গুলিবর্ষণ করেছিল। তাঁর ভাষ্যে, শেখ কামাল আরো জোরে চিৎকার করে বলতে থাকেন আমি শেখ কামাল। একথা শুনে সার্জেন্ট গুলি বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েই দৌড়ে মাইক্রোবাসের কাছে আসেন এবং ভয়ে কান্নাকাটি শুরু করেন। সার্জেন্ট বলেন, আমাদের ভুল হয়েছে। আমি বুঝতে পারিনি, আমাকে মাফ করে দিন।
দুর্ঘটনা পরেরদিন দৈনিক মর্নিং নিউজে বিস্তারিতভাবে সংবাদটি ছেপেছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক এবিএম মুসা। তিনি এ নিয়ে বহুবার স্মৃতিচারণও করেছেন।
২০১০ সালে এবিএম মুসা স্মৃতিতে কামাল-জামাল-রাসেল রচনায় লিখেছেন, যে ঘটনাকে ব্যাংক লুটেরা অপচেষ্টা বলে রটনা করা হয়েছিল, বাস্তবে ঘটনাপ্রবাহ ছিল ভিন্নতর। সে রাতে কতিপয় দুষ্কৃতকারীর ব্যাংক লুটের ষড়যন্ত্রের খবরটি কামাল আগেই জানতে পেরেছিলেন তাঁর সদ্য গঠিত আবাহনী ক্রীড়াচক্রের ফকিরাপুলে অবস্থানকারী দুজন খেলোয়াড়ের মাধ্যমে। তিনি মতিঝিল এলাকায় জিপে করে ছুটে যান তরুণ সাঙ্গীদের নিয়ে। তাঁর মাধ্যমে খবর পেয়েই ঢাকার পুলিশ সুপার বীরবিক্রম মাহবুবের পুলিশ বাহিনী সন্ত্রাসীদের ধাওয়া করে, দুজনকে পায়ে গুলিবিদ্ধ করে।
সেই রাতে আমি বঙ্গবন্ধু কর্তৃক সম্পাদক পদে সদ্য নিযুক্তি পেয়ে দৈনিক মর্নিং নিউজে কাজ করছিলাম। মতিঝিলে গোলাগুলির শব্দ পেয়ে আমি একজন প্রতিবেদককে পাঠিয়েছিলাম। আশপাশের এলাকার লোকজনের কাছ থেকে প্রকৃত ঘটনা জানার পর মর্নিং নিউজে এ সম্পর্কীয় ছোট একটি সংবাদও ছাপা হয়েছিল। ছাপানো সত্য ঘটনাটি কুৎসার নিচে চাপা দিয়েছিল স্বাধীনতাবিরোধী কামালের চরিত্র হননকারীরা।
তৎকালিন জাসদ নেতারাই শেখ কামালকে ব্যাংক ডাকাতির অপবাদ দিয়েছিল। এ দলটি এখন আওয়ামী লীগের সাথে মহাজোটে আছে। আবুল ফজল বার্তা সংস্থা এনাকে জানিয়েছেন, সকালে বিজয় দিবসের মহাসমাবেশে জাসদের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয় যে, শেখ কামাল দলবল নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
সারাদেশে খবরটি বাতাসের চেয়েও দ্রুত বেগে ছড়িয়ে পড়ে। হলিডের মতো পত্রিকা ষড়যন্ত্রীদের পাল্লায় পড়ে শেখ কামালকে নিয়ে ভুল তথ্য পরিবেশন করে। এদিন বিখ্যাত টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক পিটার হেজেল হাস্ট ঢাকায় ছিলেন। তাকে এ সংবাদটি টেলিগ্রাফে পাঠানোর জন্যে বললে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ছেলের ব্যাংক ডাকাতির দরকার কি? টাকা চাইলে তো ব্যাংক ম্যানেজারই তাঁকে টাকা এনে দেবেন। অভিনেত্রী ডলি জহুর শেখ কামালকে কাছ থেকে দেখেছেন। তিনি ব্যাংক ডাকাতি প্রসঙ্গে লিখেছেন, কামাল ভাই যদি এত বড়ই লুটেরা হবে তাহলে সেসব টাকা গেল কই? ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর বাসায় কিছুই পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি উল্লেখ করার মত তেমন কোন ব্যাংক একাউন্ট। তাহলে ব্যাংক লুটের টাকা কোথায় গেল।
অন্যদিকে মেজর ডালিম চাকুরিচ্যুত হন সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অবঃ) বীরবিক্রমের লেখা এক জেনারেলের নিরব সাক্ষ্য : স্বাধীনতার এক দশক গ্রন্থে কর্ণেল ডালিমের স্ত্রী ও চাকুরিচ্যুতের বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসের শেষদিকে ঢাকায় এক বিয়ের অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রভাবশালী নেতা এবং বাংলাদেশ রেডক্রসের চেয়ারম্যান গাজী গোলাম মোস্তফার জনৈক ঘনিষ্ট আত্মীয় ও তার সঙ্গীরা মেজর শরীফুল হক ডালিমের স্ত্রীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করে। এর প্রতিশোধ হিসেবে মেজর ডালিম তার কিছু সঙ্গী আর্মি অফিসার এবং সৈনিক নিয়ে গাজী গোলাম মোস্তফার বাসা আক্রমণ ও তছনচ করে। এর ফলে সামরিক শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধে কয়েকজন অফিসারকে সেনাবাহিনীর প্রশাসনিক আদেশে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।
এরমধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মেজর শরীফুল হক ডালিম এবং এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী। মইনুল হোসেন চৌধুরী বীরবিক্রমের এমন বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয় মেজর ডালিমের স্ত্রীর সাথে কারা অসৌজন্যমূলক ব্যবহার করেছিল এবং কেন ডালিম চাকুরিচ্যুত হয়েছিল। ওই বিয়ের অনুষ্ঠানে শেখ কামাল উপস্থিত ছিলেন। এই উপস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা শেখ কামালের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়। অথচ শেখ কামাল স্পষ্টতই নির্দোষ ছিলেন। কেবল মইনুল হোসেনই নন, স্বয়ং মেজর ডালিমও সেদিনের বিয়ে বাড়ির ঘটনাটি লিখেছিল। তার যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি বইয়ের ৪২৭ পৃষ্ঠা থেকে শুরু করে ৪৪০ পৃষ্ঠা পর্যন্ত বিয়ের বাড়ির ঘটনাটির বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। ডালিম এ গ্রন্থে একচেটিয়াভাবে নিজেকে ও স্ত্রীকে অপহরণের জন্যে গাজী গোলাম মোস্তফাকে দায়ী করছিল। তার জবানীতে সেদিনের ঘটনায় কোথাও শেখ কামালের নাম উল্লেখ করা হয়নি, তাঁকে দায়ীও করা হয়নি।
তাহলে ডালিমের স্ত্রীকে অপহরণের অভিযোগের সত্যতা কোথায়? এ অভিযোগের ভিত্তি কি? শেখ কামালকে চরিত্রহীন বলে অপপ্রচার করে কাদের লাভ? অপপ্রচারকারীদের লক্ষ্য বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতি ঘৃণা ছড়ানো। মুক্তিযুদ্ধ ও আওয়ামী লীগকে যারা প্রতিপক্ষ মনে করে তারাই শেখ কামালের বিরুদ্ধে এসব কথা পূর্বেও ছড়িয়েছে, এখনও ছড়িয়ে যাচ্ছে। কয়েকযুগে বাংলাদেশ অনেক বদলে গেলেও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর বিষয়টি একটুও বদলায়নি। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের এত অর্জন তারপরও বিভিন্ন মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের এ দলটির বিরুদ্ধে বহুধরনের অপপ্রচার ও ভুল তথ্য সাধারণ মানুষের কাছে প্রচার করা হচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রমকে ধর্মের সাথে মিলিয়ে আন্তজার্তিক গণমাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। যা আন্তজার্তিক অঙ্গনে সরকারের ভাবমূর্র্তি নষ্ট করছে। প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়েও চলছে মিথ্যা প্রচারণা। ষড়যন্ত্রকারীদের এই রটনাগুলো সচেতন মানুষ বিশ্বাস করছে না ঠিকই, কিন্তু গ্রামের মানুষ ও শহরের অনেক শিক্ষিত নাগরিকই তা বিশ্বাস করছে। ফলে তৃণমূল পর্যায়ে ও আন্তজার্তিক অঙ্গনে আওয়ামী লীগের ইমেজ ক্ষুন্ন হচ্ছে। এর প্রভাব যে নির্বাচনে পড়বে তা বলাই বাহুল্য। আমার ধারণা, গত ৫-৬ বছরে দলকে নিয়ে যা অপপ্রচার করা হয়েছে, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। এজন্যে আওয়ামী লীগকে এখনই পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন হতে হবে। তণমূল নেতাদের এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে হবে।
No comments:
Post a Comment