একুশে মিডিয়া, গাইবান্ধা প্রতিনিধি:>>>
হাসপাতালটির
মূল ফটক থেকে শুরু করে কোথাও কোনো দারোয়ান বা নিরাপত্তাকর্মী নেই। জরুরি
বিভাগের সামনেও রোগী আর তাদের স্বজন ছাড়া আর কেউ নেই। রোগীদের আহাজারি আর
হট্টগোল পেরিয়ে টিকিট কাউন্টার পর্যন্ত পৌঁছালে দেখা যায়, নিশ্চিন্তে
ঘুমাচ্ছে দু’টি কুকুর।
গরু-ছাগলের
মল-মূত্র পেরিয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের দিকে এগিয়ে গেলে দেখা গেল,
হাতের বামে একাধিক চিকিৎসকের রুম। কিন্তু কোনো কক্ষেই চিকিৎসক নেই। কোনোটা
তালা কোনোটা ফাঁকা, কোনোটাতে বিছানা আর মশারি টাঙানো। এই করিডরেও বিনা
বাধায় ঘুরে বেড়াচ্ছে-ককুর-ছাগল। কিছুটা এগিয়ে গেলে জরুরি বিভাগের কক্ষ,
টিকিট দেখা বা সিরিয়ালের কোনো বালাই ছাড়াই সেখানে ভিড় করেছেন রোগীরা।
গাইবান্ধার
পলাশবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিত্র এটি। হাসপাতালটি ৫০ শয্যার।
কিন্তু হাসপাতালের চিকিৎসক কোথায়? এই প্রতিবেদক জানতে চাইলে চিকিৎসকের
চেয়ারে বসা জিনস প্যান্ট আর টি-শার্ট পড়া অল্পবয়সী পুরুষটি কোনো উত্তর
দিলেন না। নিশ্চুপ ছিলেন পাশের চেয়ারে বসা দুই সহকারীও। রোগীরা বললেন,
ওনারাই নাকি ডাক্তার।
চিকিৎসকদের
অ্যাপ্রন নেই কেন? এবারও কোনো উত্তর নেই। রোগীদের মধ্য থেকেই একজন
জানালেন, এখানকার ডাক্তাররা অ্যাপ্রন পড়েন না। কে ডাক্তার, আর কে রোগী
বোঝাই যায় না।
সাংবাদিকদের
পরিচয় জানতে পেরে এবার ডাক্তারের চেয়ারে ডেকে আনা হলো আরেকজনকে। জানালেন
তিনি ডা. মাহবুব। এখানকার মেডিকেল অফিসার। হাসপাতালটির এমন দশা কেন?
চিকিৎসকরা কোথায়? জানতে চাইলে ডা. মাহবুব বলেন, ‘আমরা ইউনিফর্ম (অ্যাপ্রন)
পরি না। এখানে আমাদের কোনো সিকিউরিটি নেই। ভয়ে পরি না। গত ১১ মাস এই
হাসপাতালে আছি। কয়েক দফায় অপ্রীতিকর ঘটনার মুখে পড়েছি। রোগীর স্বজনরা
মেরেছেও। গত মাসেও মারধরের শিকার হই। পরে স্থানীয়রা এসে বাঁচিয়েছেন। আমিই
এই হাসপাতালে সব থেকে লম্বা সময় টিকে আছি (১১ মাস)। এর আগে যারাই এখানে
এসেছেন, দেড়-দুই মাসের মাথায় চলে গেছেন। ক’দিন আগেও একজন নারী চিকিৎসক যোগ
দিয়েছিলেন। এমন পরিস্থিতি দেখে তিনি চলে গেছেন।
ডা.
মাহবুব ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, এখানে যে কেউ আমাদের দুই-চারটা চড়-থাপ্পড় দিলেও
দেখার কেউ নাই। এখানে চিকিৎসকদের জন্য ন্যূনতম নিরাপত্তাও নেই।
নাম
প্রকাশ না করার শর্তে আরেক চিকিৎসক বলেন, ‘কী সেবা দেবো, বলেন তো? এখানে
চিকিৎসকের পোস্ট ১৯টি। কিন্তু আমরা এখানে আছি মাত্র চার জন। ওটি (অপারেশন
থিয়েটার) নেই, অর্থোপেডিকসহ অনেক বিভাগে চিকিৎসক নেই। এত বড় হাসপাতালে
সুইপার মাত্র তিন জন। এখানকার বাবুর্চি মারা গেছে একবছর। তাই মালি এখন
বাবুর্চির কাজ করেন। দুইটি অ্যাম্বুলেন্স আছে, কিন্তু ড্রাইভার একজন।
তারপরও আমরা আমাদের অবস্থান থেকে সর্বোচ্চটুকু দিয়ে রোগীদের সেবা দেওয়ার
চেষ্টা করি। এসব নিয়োগ আমলাতান্ত্রিক জটিলাতায় আটকে আছে।’
চিকিৎসকরা
যেখানে রোগী দেখছেন, তার পাশেই বেডে তিন ঘণ্টা ধরে শুয়ে ব্যথায়
কাতরাচ্ছেন সড়ক দুর্ঘটনার শিকার এ কে এম আমির ফয়সাল (৪২) নামের স্থানীয় এক
রোগী।
ফয়সালের স্বজনরা
জানালেন, বাস দুর্টনায় কোমরের একপাশে ভেতরে কাঁচ ঢুকে গেছে। খুব রক্তক্ষরণ
হচ্ছে। এখানে নাকি ওটি নেই। তাই রক্তক্ষরণ বন্ধ করা যাচ্ছে না। ডাক্তাররা
ছাড়পত্র দিয়েছেন। কিন্তু রংপুর নিয়ে যাওয়ার মতো টাকা নেই। এক স্বজন বলেন,
‘এই হাসপাতালে নাকি অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভারও নেই। কীভাবে নেব? টাকা জোগাড়
করার চেষ্টা করছি, যেন একটা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে পারি।’
নিচতলার
জরুরি বিভাগ থেকে অপরিচ্ছন্ন করিডর ও সিঁড়ি পেরিয়ে দোতলার একপাশে সাধারণ
রোগীদের ওয়ার্ড। আরেকপাশে ডেলিভারি ওয়ার্ড। ওয়ার্ডগুলোর মাঝে নার্সেস
স্টেশন। ওয়ার্ডগুলোর ভেতর-বাইরে দুর্গন্ধ আর নোংরা আবর্জনায় (হাসপাতাল
বর্জ্য) ভরা।
কাশিয়াবাড়ী
এলাকা থেকে আসা শামসুননাহার জানান, তার স্বামী ডায়ারিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায়
এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন দুই দিন আগে। বলেন, ‘গন্দ নাকতিসে (গন্ধ
লাগছে)। ময়লা আর গন্দে অসহ্য নাকতিসে। এজন্যি এটি মোরা হাজার অসুবিদা হলেও
আসিন্যা, গাঁয়ের কবরাজের কাচেই যাই (এজন্য হাজার অসুবিধা হলেও আমরা এখানে
আসি না, গ্রামের কবিরাজের কাছে যাই) ।’
কিশোরগাড়ী
থেকে আসা আরেক রোগী আসমা বলেন, ‘বাথরুমে ঢুকতেও পারবেন না, এত নোংরা। কাল
রাত থেকে পানি নেই। দুর্গন্ধে পেট ফুলে উঠে। বাথরুম পরিষ্কারের কথা বললে
আয়ারা বলে, তোমরাই সাফ করো। তিন দিন ধরে আছি। একদিনও বাথরুম পরিষ্কার করেনি
কেউ। এভাবে রোগী নিয়ে থাকা যায়?’
হাসপাতালটির
ডেলিভারি ওয়ার্ডের পাশে মাতৃদুগ্ধ সেবা রুমটিও অপরিছন্ন। সেখানে বিছানায়
চাদর পর্যন্ত নেই। বিছানার এক কোণে হাতে স্যালাইন ঝুলে থাকা অবস্থায় ব্যথায়
কাতরাচ্ছেন ইদ্রিস আহমেদ (৫০)। জানালেন কোমরপুর এলাকা থেকে এসে রাত ৩টায়
তিনি ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু কোনো ধরনের সেবাই পাচ্ছেন না।
তিনি
বলেন, ‘স্যালাইন পুশ করতে যিনি আসলেন, তিনি ডাক্তার না নার্স বুঝতেই
পারলাম না। কোনো অ্যাপ্রন নেই। পেট ব্যাথায় মারা যাচ্ছি। সাথে কোনো স্বজনও
নেই। ওষুধের লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছেন । বললাম একটু এনে দিতে। কিন্তু বলল, এটা
তো ক্লিনিক না। এত সেবা দেওয়া যাবে না। একটু ব্যাথাটা যদি কমত, চলে যেতাম।
কিন্তু এত তীব্র ব্যথায় নড়তেও পারছি না। এটা কোনো হাসপাতাল, বলেন? দেখেন কী
পরিমাণ নোংরা।’ একনাগারে অভিযোগ করে আবারও ব্যাথায় কাতরাতে থাকেন ইদ্রিস।
যদিও
নার্সেস স্টেশনে বসা সেবিকা শিউলি আক্তার ইদ্রিসের অভিযোগ অস্বীকার করে
বলেন, ‘আমরা সাধ্যমতো সেবা দিচ্ছি। সব ওষুধ থাকে না, তাই কিনতে হয়
রোগীদের।’ ৫০ শয্যার এই হাসপাতালে গড়ে ৬০ থেকে ৭০ জন রোগী ভর্তি থাকে বলেও
জানান শিউলি।
হাসপাতালের
অপরিচ্ছন্নতার বিষয়টি মেনে নিয়ে এই সেবিকা বলেন, ‘রোগীদের কথা কী বলব!
আমাদের রেস্ট রুমটাতে যান। সেখানে বেসিনের পাইপ ফুটো। সারা দিনরাত পানি পড়ে
আমাদের মেঝেটা সয়লাব। বাথরুমের অবস্থাও খারাপ, নোংরা। বিছানা নেই
,ম্যাটট্রেসও নেই। আমাদের নার্সেস কোয়ার্টারের জানালা-দরজা ভাঙা। সেখানে
কোনো পানির ব্যবস্থা নেই। রাতে চোরের উৎপাত। আমরা এখানে রাতে থাকতে পারি
না। দূর থেকে প্রতিদিন আসতে হয় আমাদের। আমি রংপুর থেকে প্রতিদিন যাতায়াত
করি।’
শিউলি বলেন, ‘এখানে
রোগীরা এসে খুব গালাগাল করে। ওটি নেই, অ্যানেসথেসিয়ার জন্য কোনো চিকিৎসকও
নেই। এখানে ডেলিভারির জন্য ভর্তি হওয়া কোনো রোগীর ক্রিটিক্যাল অবস্থা হলে
আমরা বিপদে পড়ে যাই। তখন তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করতে
হয়।’
গাইবান্ধা জেলার
পলাশবাড়ি উপজেলায় প্রায় তিন লাখ মানুষের বসবাস। এখানকার দুই উপজেলার
(সাদুল্যাপুর-পলাশবাড়ী) মানুষের জন্য এটি একমাত্র স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র।
এই ৫০ শয্যাবিশিষ্টি উপজেলা কমপ্লেক্সের এমন বেহাল দশার বিষয়ে পলাশবাড়ী
উপজেলা চেয়ারম্যান একেএম মোকছেদ চৌধুরী বলেন, গত পরশুও আমি হাসপাতালে গেছি।
নানা ধরণের সমস্যা সেখানে। এসব সমস্যা সমাধানে অনেকবার এখানকার থানা হেলথ
অফিসারকে জানিয়েছি। ছবি পর্যন্ত তুলে দেখিয়েছি। কিন্তু উনি কোন উদ্যোগই নেন
না। উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে আমার বরাদ্দ বা ক্ষমতার বাইরে এসব। কি করে
এই সমাধান করব বলেন। এলাকার গরীব মানুষরা এই হাসপাতালে কোন সেবাই পাচ্ছে
না। আর যারা সেবা নিতে আসেন তারাও নানা ধরণের ভোগান্তিতে পড়ে।
গাইবান্ধা
জেলার সিভিল সার্জন ডা. এ বি এম আবু হানিফের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন,
‘আমি তো প্রতিমাসে ভিজিট করি। এমন বেহাল দশা তো দেখিনি। কোথায়
স্বাস্থ্যসেবা নেই? সব ঠিকঠাকই আছে। সবাই ঠিকঠাকমতোই সেবা পাচ্ছেন।’=
হাসপাতালে
চিকিৎসক সংকট ও অপরিচ্ছন্নতার বিষয়ে জানতে চাইলে এই সিভিল সার্জন বলেন,
‘সারাদেশেই এই সংকট আছে। ওই হাসপাতালেও মেডিকেল অফিসারের কিছু পোস্ট ফাঁকা
আছে। কিন্তু ৩৯তম বিএসএসের চিকিৎসক নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হলেই উপজেলা হেলথ
কমপেক্সগুলোতে চিকিৎসক সংকট আর থাকবে না।’=
ডা.
আবু হানিফ আরও বলেন, নিরাপত্তার ভয়ে চিকিৎসকরা অ্যাপ্রন পরেন না— এমনটা
আমাকে কেউ বলেনি। আর নিরাপত্তার ইস্যু তো আমার দেখার বিষয়ও না। ওখানকার
ডাক্তাররা এসব সমস্যার কথা তাকে জানাননি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।=
একুশে মিডিয়া/এমএসএ=
No comments:
Post a Comment