লেখক-রকিবুল হক সায়েম:
নারী পুরুষ মিলে সমাজ হলেও নারী নিয়ে আলাদা কিছু ইতিবাচক, নেতিবাচক চিন্তা বিদ্যমান। তাদের অধিকার, ক্ষমতায়ন, অগ্রগতি, শিক্ষা, সামাজিক অবস্থা বিষয়ে যুগ যুগ ধরে বহু আলোচনা, সমালোচনা, আন্দোলন চলে আসছে। বিশেষ করে তাদের মধ্যে বড় হওয়ার স্বপ্ন, পথচলা, ভালো কিছু করার স্বপ্ন, আত্মবিশ্বাসে বাঁধা প্রভৃতি বিষয়গুলো সচেতন মহলকে খুবই ভাবায়। একজন পুরুষের মতো মেয়েদের অভিন্ন শিক্ষার অধিকার, পরিপুষ্টি, আইনি সহায়তা এবং ন্যায় অধিকার, চিকিৎসা সুবিধা ও বৈষম্য থেকে সুরক্ষা, নারীর বিরুদ্ধে হিংসা ও বলপূর্বক বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের পরিপূর্ণ অধিকার রয়েছে।
অধিকারে যখন হস্তক্ষেপ বা পরিপূর্ণতা না পায় তখন আন্দোলনে রূপ নেয়। নারী ক্ষমতায়নের আন্দোলন বিশ্বব্যাপী আলোচিত এবং চলমান। আন্দোলনগুলোতে সাধারণ মানুষের সমর্থন বা অংশগ্রহণ কম। অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা ঘটলে আমরা প্রচুর মানববন্ধন করি, সভা-সেমিনার ডাকি, আলোচনা করি। কর্মসূচিতে মুষ্টিমেয় আয়োজক ছাড়া সাধারণ মানুষের তেমন দেখা যায় না। ছাত্র ছাত্রীদেরও দেখা মিলে না। তবে এসবে মেয়েদের অংশগ্রহণ শতভাগ হওয়ার কথা হলেও আশানুরূপ নয়। নিজেরা শিক্ষার সুযোগ না পেলেও, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে না পারলেও , সাধারণ দরিদ্র বা গ্রামীণ নারী বা কিশোরীর অধিকার লঙ্ঘন হলেও তারা কিছু বলেন না। এর পেছনে বড় কারণ, আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বিষয়গুলো দেখতে দেখতে একরকম প্রতিদিনকার ঘটনার মতো মেনে নিতে শিখে গিয়েছি। মেয়েদেরও তা সহ্য প্রায়। আন্দোলন যে একমাত্র সমাধান তা নয়।
নারীর পরিপূর্ণতায় বাংলাদেশে অনেক আইন ও নীতিমালা রয়েছে। তবুও যৌতুক, পারিবারিক নির্যাতন, এসিড সন্ত্রাস, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, সম্পত্তিতে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে তারা। নারী ও শিশু নির্যাতন আদালত, পারিবারিক আদালত এবং ফৌজদারি আদালতে নারী সংক্রান্ত বিষয়ে বছরের পর বছর মামলার নিষ্পত্তি না হওয়ায় নারীরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে এলেও উচ্চপর্যায়ের কর্মক্ষেত্রে নারীরা এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়ন বাড়েনি।
দেশে নারী উন্নয়ন ও সমতার লক্ষ্যে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (MDG) ও দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্রের (NSAPR) আলোকে নারী উন্নয়ন নীতিমালা বাস্তবায়নকল্পে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন মহিলাবিষয়ক অধিদফতরের মাধ্যমে উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের সর্ববৃহৎ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী দুস্থ ও অসহায় এবং শারীরিকভাবে অক্ষম মহিলাদের উন্নয়ন স্থায়িত্বের জন্য খাদ্যশস্য ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। মহিলা কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বাগেরহাট, মহিলা হস্তশিল্প ও কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, দিনাজপুর, মা ফাতেমা (রা:) মহিলা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কমপ্লেক্সসহ এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দেশের নারী সমাজকে উন্নয়নের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। নারীবান্ধব আবাসিক/অনাবাসিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বৃত্তিমূলক ও ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। দরিদ্র মায়ের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান কর্মসূচী, মাতৃত্বকালীন মৃত্যুহার হ্রাসে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, গ্রামের দুস্থ, প্রান্তিক, দলিত, গ্রামভিত্তিক কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে নারী বৈষম্যের মাপকাঠিতে দেশের সার্বিক স্কোর মাত্র ৪৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ। যেখানে আটটি সূচকে দেখানো হয়েছে তাদের পরিস্থিতি। যেমন রয়েছে সম্পত্তির অধিকার, বিয়ে করা বা সন্তান নেওয়া, কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি লাভের সুযোগের মত দিকগুলো। “নারী, ব্যবসা ও আইন ২০১৯ শীর্ষক” এই প্রতিবেদনটি তৈরির জন্য বিশ্বব্যাংক গত ১০ বছর ধরে বিশ্বের ১৮৭ টি দেশে পর্যবেক্ষণ চালিয়েছে।
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এবং জঁ দ্রজ তাঁদের ভারত: উন্নয়ন ও বঞ্চনা (২০১৫ সালে প্রকাশিত) বইয়ে লিখেছেন, ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে নারীর অগ্রগতি অনেক বেশি। বাংলাদেশে ৫৭ শতাংশ নারী কর্মজীবী। ভারতে এ হার ২৯ শতাংশ। তাঁরা দেখিয়েছেন, নারীর সাক্ষরতা ও শিক্ষাতেও বাংলাদেশ এগিয়ে।
তারপরও বাংলাদেশে নারীর সমতায়নে বহুদুর এগিয়ে যেতে হবে। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা ছাড়া মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও জনগণের ক্ষমতায়ন সম্ভব নয় । সামাজিক উন্নয়নে এবং নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইনগুলোর বাস্তবায়নের হার বৃদ্ধি করতে হবে। ইতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারে রাষ্ট্রকে পালন করতে হবে অগ্রণী ভূমিকা। মর্যাদা নিশ্চিত না হলে নারীর প্রতি সহিংসতা ঠেকানোও কঠিনতর হবে। সমাজ, রাষ্ট্রের সাথে নারীদেরও অগ্রণী ভ’মিকা রাখতে হবে।
শিক্ষার্থী: রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ, চট্টগ্রাম।
একুশে মিডিয়া/এমএসএ
No comments:
Post a Comment