ভূল চিকিৎসায় এবং চিকিৎসা অবহেলায় একের পর এক মৃত্যুর অভিযোগ উঠছে নগরীর বেসরকারি ‘ম্যাক্স হাসপাতাল’-এর বিরুদ্ধে।
এরই
মধ্যে অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় দুই বছরে তিন শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ পাওয়া
গেছে। এর মধ্যে একটি অভিযোগ জমা পড়েছে সিভিল সার্জন কর্তৃপক্ষের
কাছেও।অন্যটির মামলা চলমান। এখন নতুন করে আবারও একটি মামলা গেল আদালতে।
ডাক্তারের অবহেলায় মায়ের গর্ভে সন্তানের মৃত্যুর অভিযোগে হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে নিহতের পরিবার। এ মামলা তদন্তের দায়িত্ব পড়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভিস্টগেশনের ওপর (পিবিআই)।
গেল
বছর হাসপাতালে জ্বর ও গলাব্যথা নিয়ে ভর্তি হওয়া সাংবাদিক রুবেল খানের
শিশুকন্যা রাফিদা আক্তার রাইফার মৃত্যু হয়। তখন ভুল চিকিৎসার অভিযোগে
ম্যাক্স
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও দায়ী চিকিৎসকদের বিচারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন
সাংবাদিকরা। এ ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের টিম
হাসপাতালে অভিযানও চালিয়েছিল। কিছুদিন আগে ২১ নভেম্বর লেখিকা ও অগ্রণী
ব্যাংকের কর্মকর্তা মোহছেনা আক্তার ঝর্ণার ১৩ মাস বয়সী ছেলে জিহান সরোয়ার
প্রিয় ম্যাক্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। মা ঝর্ণার অভিযোগ
ছিলো চিকিৎসায় অবহেলার কারণেই মারা যায় সন্তান। পরপর শিশু মৃত্যুর ঘটনা বাড়লেও তৎপরতা নেই অভিযোগ তদন্তের।
রোববার (৮ ডিসেম্বর) চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন
ম্যাজিস্ট্রেট সরওয়ার জাহানের আদালতে মামলাটি করেছেন ভুক্তভোগীর স্বামী
আইনজীবী ইউসুফ আলম মাসুদ। মামলায় অভিযুক্ত তিনজন হলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল
কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও ম্যাক্স হাসপাতালের
কনসালটেন্ট ডা. আফরোজা ফেরদৌস, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের অধীন চমেক
হাসপাতালের নিউক্লিয়ার মেডিসিন ও আলট্রাসাউন্ড কেন্দ্রে কর্মরত ডা. এএইচএম
রকিবুল হক এবং ম্যাক্স হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. মো. লিয়াকত আলী
খান। নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, প্রসূতি শারমিন আক্তার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর ২৪ এপ্রিল থেকে ডা. আফরোজা
ফেরদৌসের তত্ত্বাবধানে ম্যাক্স হাসপাতালে নিয়মিত চিকিৎসাধীন ছিলেন। ৫ মে আল্ট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট অনুসারে প্রসবের সম্ভাব্য
তারিখ ছিল ১১ ডিসেম্বর। পরবর্তীতে ১৩ অক্টোবরের আল্ট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট
অনুযায়ী প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারিত হয় ১৭ ডিসেম্বর। এর আগে ২৮
অক্টোবরও আফরোজ ফেরদৌসের কাছে রোগীর নিয়মিত চেকআপ করানো হয়।
গত
১ ডিসেম্বর শারমিন আক্তার পেটে ব্যথা অনুভব করলে তাকে রাত সাড়ে ৮টার দিকে
আবারও চিকিৎসক আফরোজা ফেরদৌসের কাছে নিয়ে গেলে ডা. আফরোজার পরামর্শ অনুযায়ী
আল্ট্রাসনোগ্রাফি করানো হয়। পরবর্তীতে আবারও রোগী পেটে ব্যথা অনুভব করায়
পুনরায় ওইদিনই ম্যাক্স হাসপাতালের ল্যাবে ডা. এএইচএম রকিবুল হকের কাছে নিয়ে
গেলে আল্ট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট অনুসারে রোগীর গর্ভে বাচ্চার অবস্থান ঠিক
আছে বলে দাবি করেন ডা. আফরোজা।
পরবর্তীতে তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী রোগীকে এলজিন ৫০ মিলিগ্রাম ওষুধ রাতে এবং পরদিন সকালে খাওয়ানো হয়। পরবর্তীতে
ব্যথা স্বাভাবিক হলেও ৩ ডিসেম্বর আবারও তীব্র ব্যথা অনুভব করলে রোগীকে
দুপুর ১টার দিকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে
চিকিৎসক সুমাইয়া রফিকের তত্ত্বাবধানে রোগী মৃত ও গলিত কন্যাসন্তান প্রসব
করেন। এদিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা.সুমাইয়া রফিক জানান, একদিন আগেই গর্ভে ওই সন্তানের মৃত্যু হয়েছে।
এরই প্রেক্ষিতে ভুক্তভোগীর স্বামী মো.
ইউসুফ আলম মাসুদ আদালতে মামলা দায়ের করেন। মোঃইউসুফ আলম মাসুদ জানান, ‘ডা.
আফরোজা গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা না করায় এবং মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে মাত্র
৫ মিনিটের মধ্যে ডাক্তার রকিবুল হক ইউজিসি প্রতিবেদন তৈরি করায় সঠিক
চিকিৎসা ও ইউজিসি প্রতিবেদনের অভাবে গর্ভে আমার সন্তানের মৃত্যু হয়েছে।
তিনি
আরও বলেন, ‘ডাক্তারকে বারবার আমার স্ত্রীর সমস্যার কথা বলার পরেও তিনি
গুরুত্ব না দিয়ে ডেলিভারির সময়ে আসার জন্য বলেছেন। উনি গুরুত্ব দিলে আমার
এই দিন দেখতে হতো না। অদক্ষতা ও অবহেলায় কত পরিবারের হাসি কেড়ে নেয় তারা।!
তবে
অভিযোগ প্রসঙ্গে দ্বিমত জানিয়েছেন অভিযুক্ত ডাক্তার আফরোজা ফৈরদৌস। তার
বক্তব্য হলো,উনার আগের দুই বাচ্চার সময়ও আমার পরামর্শ নিয়েছেন। উনি তো আমার
অপরিচিত নন। তৃতীয় বাচ্চার সময়ও আমার কাছে এসেছেন।
শেষবার ১ তারিখে পেট ব্যথা নিয়ে এলে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করতে বলি। রিপোর্ট
পুরো
ভালো। তাই তাদের বলেছি ডেলিভারির যে কোনো উপসর্গ দেখা দিলেই চলে আসবেন।
অন্য রোগীদের ক্ষেত্রে যা বলি উনার ক্ষেত্রেও সেটা বলা হয়েছে। এরপর আমার
সাথে আর কোনো যোগাযোগ নেই।
আফরোজা ফেরদৌস বলেন,
‘এরপরে ৩ তারিখ মেট্রোপলিটন থেকে ফোন আসে আমার রোগী ওইখানে গেছে। ডেলিভারিও
হয়েছে। তখন আমি জানতে চাইলাম, যেহেতু হয়েই গেছে এতে আমার কাজ কী।
তখন
জানায় বাচ্চাটি মৃত হয়েছে। আমাকে যেতে হবে। আমি চেম্বার থেকে সন্ধ্যা ৬টায়
সেখানে গিয়ে রোগীর সাথে কথা বলি। রোগী জানায়, সেদিন সকালেও তার বাচ্চার নড়াচড়া ছিলো। এখন বলেন এখানে আমার দোষ কোথায়? আমি তো সিনের (দৃশ্যের) ভেতরই নেই। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘তাছাড়া ডেলিভারি পেইন উঠলে ডেলিভারি হতে প্রায় ৬ ঘন্টা সময় লাগে। আসার সাথে সাথে কী করে ডেলিভারি হয়?
তাছাড়া
অন্য রোগীরা যেখানে বারবার আপডেট জানায়। সেখানে (মেট্রোপলিটন হাসপাতাল)
যাওয়ার আগেও আমার সাথে যোগাযোগ করেনি তারা। আর হলেও এখানে আমার দোষটা
কোথায়? আমার কাছে তো প্রমাণ আছে। উকিল সাহেব তো উকালতির জোরে গায়ের জোরে
কথা বলতে পারেন না। উনি যেমন প্রমাণ নিয়ে কথা বলেন। আমাদেরও প্রমাণ আছে। আর
উনি তো বললেই হবে না।
আল্ট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট ভুল প্রসঙ্গে ডা. আফরোজা
ফেরদৌস বলেন, ‘যিনি আল্ট্রাসনোগ্রাফি করেছেন উনি তো ছোট বাচ্চা না আর কাজ
তো আজকে থেকে করেন না। তিনি সিনিয়র এবং তার একটা মান সম্মান-রেপুটেশন আছে।
গায়ের জোরে চাপায় দিতে পারেন না।
ডা. আফরোজার আঙ্গুল মেট্রোপলিটন হাসপাতালের
দিকে ঘটনার প্রাসঙ্গিকতা টেনে ডা. আফরোজা ফেরদৌস বলেন, ‘বাচ্চার
পোস্টমর্টেম রিপোর্ট ছাড়া কী করে বললেন একদিন আগেই মারা গেছে। আর এই
বাচ্চার পেটের ভেতর মারা যাওয়ার ৩০-৩৫ ভাগ কারণ অজানা। আর আমরা তো এসবের
ভেতরেই নেই।
তিনি আরও বলেন, ‘উকিল সাহেব উকালতির জোরে
আমার নামে মামলা দিয়ে দিলো। আমার কি মানসম্মান নাই? এমনি ফুঁ দিয়ে তো
ডাক্তার হয়ে যাইনি। লেখাপড়া ছাড়া তো প্র্যাকট্রিস করতে বসি নাই। এই বাচ্চা
মারা যাওয়ার পিছনে আমরা কোনোভাবেই দায়ী না। আমাদের রিপোর্ট সম্পূর্ণ ঠিক
আছে। উনি আমার নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে আমার মানসম্মান নষ্ট করায় আমিও মামলা করবো। কারণ আমার কাছেও প্রমাণ আছে।
একুশে মিডিয়া/এমএসএ
No comments:
Post a Comment