লেখক- মোহাম্মদ ইলিয়াছ:
অত্যন্ত দু:খভরা মন নিয়ে আমার “মা” নিয়ে লিখতে বসেসি। যিনি একজন মমতাময়ী ও আদর্শ মা এবং একজন পূর্ণাঙ্গ ও ধার্মিক মা। গত ১৬ জুন ২০২০ খ্রি: মঙ্গলবার ৮৮ বছর বয়সে মা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। আমার মায়ের নাম তামান্নাহার। তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে পড়ে এলাকার সকলস্তরের নারী-পুরুষ। এলাকার সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলেন আমার মা। তার শূণ্যতা পূরণ হবে কিনা জানি না। তবে মা-এর আদর্শিকতা ও ধার্মিকতা অনুকরণীয়-স্মরণীয় ও পাথেয় হয়ে থাকবে ।
“মা” শব্দটি ছোট্ট হলেও এর মত মধুর শব্দ আরেকটা খুঁজে পাওয়া যাবে না। মা হচ্ছে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। মা হচ্ছেন একজন পূর্ণাঙ্গ নারী, যিনি শুধু সন্তান জন্ম দেন না, সন্তানকে বড় করে তোলেন। মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তোলেন। সন্তানের সার্বক্ষণিক মঙ্গল কামনা করেন। সন্তানকে জীবনের চেয়ে বেশি ভালবাসেন। পৃথিবীতে সবকিছু বদলাতে পারে কিন্তু মায়ের ভালবাসা কখনো বদলাবার নয়। কোথাও মায়ের কোলের মত শান্তি পাওয়া যাবে না। মা মানে মমতা, মা মানে ক্ষমতা, মা মানে নিরাপত্তা। অন্যদিকে মা মানে নিশ্চয়তা, মা মানে সকল আশা। শত চিন্তা আপনার মাথায়, একবার মায়ের কোলে মাথা রাখলে সব চিন্তা দূর হয়ে যাবে। মা কি জিনিস যার মা নেই সেই জানে। মা না থাকলে বুঝা যায় না জীবনের ব্যাথা। মাকে হারিয়ে বুঝতেছি মায়ের উপলব্ধি ও মায়ের শূণ্যতা। মা আমাদের ছেড়ে পরকালে চলে গেলেন। মায়ের মৃত্যু যেন মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ল। নিভে গেলে আমাদের ঘরের ও পাড়ার উজ্জ্বল প্রদীপ। চলে গেলেন ঘরের লক্ষèী। মমতাময়ী মাকে হারিয়ে আজ আমরা শোকাহত।
আমার মা ছিলেন এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠ একজন মহিয়সী নারী। এলাকার নারী-পুরুষ সকলের কাছে তিনি শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র ছিলেন। পর্দানশীল,আর্দশ ও ধার্মিক নারী হিসেবে এলাকায় তিনি বেশ পরিচিত ছিলেন। বাঁশখালীর পৌরসভার উত্তর জলদী নেয়াজর পাড়ায় আমাদের পৈত্রিক বাড়ি। আমার পিতা মাওলানা মোজাহেরুল হক ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। তিনি ইন্তেকাল করেন ১৯৮৯ সালে। আমরা পাঁচ ভাই ও তিন বোন। বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণায় আমরা সকলেই শিক্ষিত ও স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। বাবাকে হারানোর পর মায়ের অনুপ্রেরণায় আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছি। কলেজে শিক্ষকতা করছি। ১৬ জুন রাত বারোটায় চট্টগ্রাম শহরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমার মা মারা যান। ১৭ জুন ভোরে প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে মায়ের লাশ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছলে এক হ্নদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। এলাকার নারী-পুরুষের চোখে-মুখে ছিল কান্নার চাপ। মায়ের লাশ ঘরের সামনের কামরায় রাখা হল। মায়ের লাশের চারিদিকে ঘরের ভেতরে-বাইরে আত্মীয়-অনাত্মীয় নারী ও ছোট ছোট শিশুরা কোরআন পাঠ ও তছবিহ পড়তে লাগল। অন্যদিকে প্রচন্ড বৃষ্টিতে এলাকার কবর খোঁড়ার একটি দল মসজিদের কবরস্থানে মায়ের কবর খুঁড়তে লাগল। সকাল সাড়ে এগারোটার মধ্যে মায়ের কবর খোঁড়া শেষ হল। জোহর নামজের পর প্রচন্ড বৃষ্টিতে স্থানীয় জলদী হোসাইনিয়া সিনিয়র মাদ্রসা প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় মায়ের জানাজা। ঘর থেকে মায়ের লাশ বের করার সময় আরেক দফা হ্নদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। পড়ে যায় ছোট-বড় সকলের মধ্যে কান্নার রোল। আমরা মায়ের লাশ কাঁধে করে জানাজা-কবরস্থানে নিয়ে যাই। জানাজায় ইমামতি করেন মেঝ বোনের স্বামী আলহাজ্ব মাওলানা মোহাম্মদ ইলিয়াছ। জানাজা নামাজের পূর্বক্ষণে আমার এক খালাতো ভাই মাওলানা নছিমুর রহমান জানাজায় আগতদের উদ্দেশ্যে আমার মায়ের আদর্শিকতা সম্পর্কে কিছু কথা তুলে ধরেন। জানাজা শেষে বাড়ির নিকটে মসজিদের কবরস্থানে বাবার পাশে মাকে দাফন করা হয়।
আমার স্মৃতিতে আমার মা একটি বাস্তবতা। একজন মমতাময়ী ও একজন আদর্শ মা। মায়ের অনুপ্রেরণায় আমার কলেজ শিক্ষকতার বয়স ২৫ বছর চলমান। মায়ের জীবদ্দশায় মাকে দেখার জন্য প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে ছুঁটে আসতাম। মায়ের সাথে একত্রে খাওয়া-দাওয়া করতাম। মা আমাকে বিভিন্ন ফল খেতে দিতেন। পরিবার-পরিজনের কথা জিজ্ঞাসা করতেন। আমি দেখেছি ইবাদত-বন্দেগীতে মা ছিলেন অবিচল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যথাসময়ে পড়ে নিতেন। অন্যকে নামাজ পড়ার তাগিদ দিতেন। নামাজ শেষে কোরআন তেলোওয়াত করতেন এবং তছবিহ জবতেন। মা প্রতিদিন ফজরের নামাজের আগে উঠে যেতেন। বাড়ির সকলকে ফজরের নামাজের জন্য ডেকে দিতেন। মা গ্রামেই থাকতেই বেশি পছন্দ করতেন। শহরে গেলেও বেশি দিন থাকতে চাইতেন না। গেল রোজার ঈদের দুই দিন আগে মা শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে আসেন। গ্রামের বাড়িতে এসে বাড়ির উঠানে, বাড়ির প্রতিটি রুমে চড়ি দিয়ে হেঁটেছেন। মৃত্যুর আগে মায়ের এটি ছিল শেষ মুভমেন্ট। মাকে দেখার জন্য ঈদের দিন আমি গ্রামের বাড়িতে যাই। মা তখনও সুস্থ। কয়েকদিন পর হঠাৎ করে মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ৭ জুন মাকে ভর্তি করানো হল চট্টগ্রামের পার্কভিউ হাসপাতালে। ৯ জুন আমি সস্ত্রীক মাকে দেখার জন্য হাসপাতালে যাই। মায়ের সাথে এটি ছিল আমার শেষ দেখা। উক্ত হাসপাতালে নয়দিন চিকিৎসা শেষে মা ইন্তেকাল করেন। মা আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু মায়ের পদধূলি আমাদের যাত্রার চালিকা শক্তি হবেই ইনশাল্লাহ। মা জান্নাতে ভাল থাকবেন আল্লাহর কাছে এই দোয়া কামনা করি।
সর্বক্ষণ সন্তানের কথা চিন্তা করে একমাত্র মা। মা ছাড়া কারোর গতি নেই। মায়ের মত দরদী কেউ আছে বলে জানা নেই। ইসলাম মাকে সর্বোচ্চ অধিকার ও সম্মান দিয়েছেন। ইসলামের বিধানমতে, আল্লাহতায়ালার পরে মায়ের স্থান। মহাগ্রন্থ আলকোরআনে বলা হয়েছে, মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। মাতা-–পিতা বার্ধ্যক্যে উপনীত হলে তাদেরকে বিরক্তি ও অবজ্ঞামূলক কথা বলবে না। তাদের সাথে সম্মান করে কথা বল। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ হও। তাদের সাথে সুন্দর আচরণ কর। মা অতিকষ্টে গর্ভে ধারণ করেছেন ও অতিকষ্টে প্রসব করেছেন এবং লালন-পালন করেছেন। আল্লাহ আরো বলেছেন যারা পিতা-মাতা উভয়কে বা একজনকে বার্ধক্য অবস্থায় পেয়েও তাঁদের খেদমতের মাধ্যমে জান্নাত অর্জন করতে পারল না, তারা ধ্বংস হোক।
মা আমাদেরকে কতই না ভালবাসতেন। তার শূণ্যতা ও ভালবাস্ াকোনদিন পূরণ হবার নয়। তার মৃত্যুতে আমরা শোকাহত ও ব্যথিত। আজীবন স্মৃতির পাতায় ও খাতায় শ্রদ্ধাভরে ধরে রাখতে চাই মমতাময়ী ও শ্রদ্ধাভাজন মা-কে।
মোহাম্মদ ইলিয়াছ
সহ: অধ্যাপক: আলহাজ্ব মোস্তফিজুর রহমান কলেজ, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম।
ই-মেইল: milias08@gmail.com
একুশে মিডিয়া/এমএসএ
No comments:
Post a Comment