মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম,বাঁশখালী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি:
বন বিট কর্মকর্তা রউফ ও রেইঞ্জার রাজ্জাকের কারসাজিতে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর পাহাড়ি এলাকার বন উজাড়ের অভিযোগ স্থানীয়দের। ১৩ নভেম্বর পুকুরিয়া বিট কর্মকর্তা এবং কালীপুর রেইঞ্জার আব্দুর রাজ্জাকের কারসাজিতে বাঁশখালীর পাহাড়ি এলাকার বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে মর্মে অভিযোগ উঠেছে।
গত ৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় পুকুরিয়ার পাহাড়ি এলাকা থেকে বনের গাছ কেটে নেওয়ার সময় পুকুরিয়া চৌমুহনী এলাকাতে স্থানীয়দের হাতে ধরা পড়ে যায় ওই গাছ।এতে উঠে আসে গাছ কাটার সাথে বিট কর্মকর্তা রউফুল এবং রেইঞ্জার রাজ্জাকের গোপন যোগসাজের কথা।
স্থানীয় সুত্রে জানা যায়, পুকুরিয়া বিট কর্মকর্তা রউফুল ইসলাম এবং রেইঞ্জার রাজ্জাক স্থানীয় প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের সাথে যোগসাজশে বনের গাছ কেটে লাখ লাখ টাকা অবৈধ উপার্জন করে যাচ্ছে।ওই দুই কর্মকর্তা গোপনে বনের গাছ বিক্রি করে অবৈধ উপার্জন করলেও গাছ কাটার মিথ্যা অভিযোগে স্থানীয় নিরহদের হয়রানি করে তারা। এরই মধ্যে গত ১৮ অক্টোবর স্থানীয় মৃত্যু নুরুচ্ছফার ছেলে মোঃ ইয়াছিন, মোঃশফিক, মোঃ রফিক ও বদিউল আলম এর বিরুদ্ধে বন বিভাগের জায়গা জবর দখলের মিথ্যা অযুহাতে মামলা দায়ের করেন বিট কর্মকর্তা রউফুল।
স্থানীয় ও ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা জানান, বিট কর্মকর্তা রউফুল বাঁশখালীতে যোগদানের পর থেকে বিভিন্ন ভাবে স্থানীয়দের কাছ থেকে চাঁদ দাবি করে থাকেন।চাঁদা দিতে না পারলে মিথ্যা অভিযোগে মামলার আসামি করার হুমকিও দিয়ে থাকেন তিনি। মৃত্যু নুরুচ্ছফার ছেলে ইয়াছিন ও তার স্ত্রী মোরশেদা বেগম বলেন,বিট অফিসার গত বছর আমাদেরকে তার অফিসে ডেকে ১লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন, আমি কৃষি কাজ করে পরিবার চালাই,এতো টাকা দিতে পারিনাই।
একই ভাবে দুই মাস আগে আবারও তিনি আমাদের কাছ থেকে ১লাখ টাকা দাবি করেন।তার দাবি মতে টাকা দিতে না পারায় বনের জায়গা থেকে আমাদের বসতঘর উচ্ছেদ করে দিবে মর্মে হুমকি দেন,
একপর্যায়ে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে আমাদের ঘরের টিনের বেড়া ভেঙ্গে দিয়েছে বলে কান্না কণ্ঠে তারা বলেন,এই দেখেন বিট অফিসার আমাদের ঘরের টিনের বেড়া ভেঙ্গে দিছে!বিট কর্মকর্তা রউফুল,রেইঞ্জার রাজ্জাক গাছ কেটে তাদেরকে ভুক্তভোগী পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানি করছে।
তিনি নিজেই বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে ৫ হাজার ১০ টাকা নিয়ে নতুন ভাবে স্থাপনা নির্মাণ করে দিচ্ছে,ওই স্থাপনা নির্মাণের জন্যে বিভিন্ন গাছ কেটে বিক্রি করে দেন।কিন্তু আমি চাঁদা দিতে না পারায় তিনি আমাদের বিরুদ্ধে বন আদালতে মামলা করেছেন।ওই দুই কর্মকর্তার হয়রানি থেকে বাঁচতে সরকার ও বন বিভাগের উর্ধতন কতৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন স্থানীয় ও ভুক্তভোগী পরিবার।
স্থানীয় আবুল বাশার, আমির হোসেন, মোঃ আলী সহ বেশ কিছু লোকজন বলেন, ভুক্তভোগী ইয়াছিনের পরিবারের কেউ গাছ কাটেনাই, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কেন মামলা করছে সেটা জানিনা। এছাড়াও তারা বিগত ২৫-৩০ বছর থেকে এখানে বসবাস করতেছে, নতুন ভাবে কোনো জায়গা তারা দখল করেনাই, তাদের পৈত্রিক মুলে দখলীয় জায়গা নিয়ে তাদের সৎ ভাইয়ের সাথে জমি বিরোধ চলছে, ওই সৎ ভাইয়ের পক্ষে নিয়েছে বিট কর্মকর্তা। বিট অফিসার এবং রেইঞ্জার মিলে নিজেরাই দৈনিক বেতন হিসেবে লোক দিয়ে গাছ গুলো কেটে বিক্রি করছে এবং টাকা নিয়ে নতুন ভাবে বিভিন্ন লোকজনকে ঘর করে দিচ্ছেন তারা। ওই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে সাহস পাচ্ছেনা, কারণ তারা গাছ কাটা ও জবর দখলের অভিযোগে স্থানীয়দের বিরুদ্ধে মামলা দেয়ার হুমকি-ধমকি দিয়ে স্থানীয়দের বাকরুদ্ধ করে দেন তারা।
এছাড়াও সৈয়দুল হক নামের এক ব্যক্তি বলেন, আমি নিজে স্বাক্ষী শুক্রবার সন্ধ্যায় যে গাছ গুলো পুকুরিয়া থেকে আটক করা হয়েছে সেই গাছ গুলো আমাদেরকে দিন মজুরি হিসেবে জনপ্রতি ৭শ টাকা করে বেতন দিয়ে কাটাইছে বিট কর্মকর্তা রউফুল। তিনি ওই গাছ গুলো তুলাতলী এলাকার গাছ ব্যবসায়ি আজমের কাছে বিক্রি করেছিলেন,আর ওই গাছ গুলো নিয়ে যাওয়ার সময় জনতার হাতে আটকা পড়ায় তিনি নিজেকে রক্ষা করতে অন্য জনের উপর দোষ চাপাচ্ছেন। গাছ কাটার সময় বন অফিসের দুইজন লোকও ছিলো বলে জানান দিন মজুর সৈয়দুল হক। কাটা গাছ গুলো জব্দ করার পর রেইঞ্জার রাজ্জাক এবং বিট কর্মকর্তা রউফুল দুইজনই এখানে এসেছিল,তাঁরা এসে দেখে গেলেও নিরব ভূমিকায় থাকেন রেইঞ্জার রাজ্জাক।
সরেজমিনে পরিদর্শনে দেখা যায়,নতুন স্থাপনা নির্মাণের দৃশ্য। স্থাপনা নির্মাণে ব্যস্ত ছকিনা বেগম,কামরুন্নাহার,রাজিয়া বেগম, আমির হোসেন সহ জানান, আমরা ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে বিট কর্মকর্তা রউফুল স্যারের কাছ থেকে এই জায়গা নিয়েছি, আমাদের ঘর করার জন্যে তিনি নিজে লোকজন নিয়ে গাছ গুলো কেটে নিয়ে গেছে। তিনি না হলে আমরা ঘর করতে পারতামনা। ইয়াছিন, রফিক, শফিক এবং বদিউল আলমরা গাছ কাটছে কিনা?তারা বলেন না, এরা কেন কাটবে? বনের গাছ বন কর্মকর্তা কেটেছে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে পুকুরিয়া বিট কর্মকর্তা রউফুল ইসলাম, বলেন,পুকুরিয়া চৌমুহনী এলাকা থেকে কিছু কাটা গাছ জব্দ করা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে বনের কিছু গাছ ভেঙ্গে যায়, আর সেই গাছ গুলো হয়তো কেটে নিয়ে যাচ্ছিল, ওই গাছ গুলো চৌমুহনী এলাকায় সড়কের পাশে রেখে স্থানীয় জবর দখলকারীরা হয়তো আমাকে এখান থেকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করছে। গত অক্টোবর মাসে আমি তাদের বিরুদ্ধে বন আদালতে বন বিভাগের জায়গা জবর দখলের বিষয়ে মামলা করেছি।আর জব্দকৃত গাছ যারা কাটছে তাদেরকেও শনাক্ত করতে পেরেছি কিন্তু এবিষয়ে এখনো কোন মামলা করিনি।মামলা প্রক্রিয়াধীন আছে,রেইঞ্জারের সাথে কথা বলে মামল করবো কিনা তা সিদ্ধান্ত হবে।
এসময় তিনি নিজেকে আওয়ামী পরিবারের সন্তান পরিচয় দেন এবং তথ্যমন্ত্রী ড.হাসান মাহমুদ ও সাবেক চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ.জ.ম নাছিরের ঘনিষ্ঠজন এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাতকানিয়ার আমিনুল ইসলাম চৌধুরী আমিনের আপন মামাতো ভাই হিসেবে সাংবাদিকদের কাছে নিজের ক্ষমতার খুঁটির জোরের বিষয়টি স্পষ্ট ভাবে তোলে ধরেন রউফুল।গাছ কাটার সাথে জড়িতদের শনাক্তের কথা রউফুল স্বীকার করলেও বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেন রেইঞ্জার রাজ্জাক।
রেইঞ্জার রাজ্জাক গাছ আটকের সত্যতা স্বীকার করে বলেন,পুকুরিয়া থেকে ১৮ পিস কাটা গাছ জব্দ করা হয়েছে। কারা কাটছে? জানতে চাইলে তিনি জানান সেটা তদন্ত করা হচ্ছে কিন্তু এখনো কাউকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এসময় তিনি নিজেকে একধরনের অসহায়ত্ব দেখিয়ে বলেন,আমাদের লোকবল একদম কম। মাত্র কয়েকজন লোক দিয়ে এতো বিশাল পাহাড়ি এলাকা দেখাশোনা করা সম্ভব না।জনবল কম হওয়াতে দেখাশোনা অসম্ভবের বিষয়টি উর্ধতন কতৃপক্ষকে অবহিত করছেন কিনা? তিনি বলেন লোক নিয়োগ দরকার তাই এই বিষয়ে উর্ধতন কতৃপক্ষে অনেক বার আবেদন পাঠানো হয়েছে।আরো বলেন, আমি একক ভাবে ৩টি দায়িত্ব পালন করতেছি।তবে গাছ বিক্রি করে অবৈধ উপার্জনের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন,এটা তদন্ত চলছে,আমাদের কোনো লোক জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।জবর দখলের অভিযোগে ইয়াছিন, রফিক উদ্দিন, শফিক ও বদিউল আলম সহ যাদের বিট কর্মকর্তা মামলা দায়ের করেছে, তারা কোনো ভাবেই গাছ কাটার সাথে জড়িত নন বলে স্বীকার করে রেইঞ্জার রাজ্জাক বলেন,যারা জড়িত তাদের ব্যাপারে উর্ধতন কতৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।
No comments:
Post a Comment