মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম:
আজ ১ মার্চ জাতীয় বীমা দিবস: বাংলাদেশে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো বীমা ব্যবস্থা। আধুনিক বিশ্বে বীমা শুধু একটি আর্থিক সুরক্ষা ব্যবস্থা নয়, বরং এটি ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের জন্য দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এবং নাগরিকদের ঝুঁকিমুক্ত ভবিষ্যৎ গড়তে বীমা অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখে। তবে, বাংলাদেশে বীমার প্রচলন অনেক পুরনো হলেও এখনো সাধারণ মানুষের মধ্যে এর গ্রহণযোগ্যতা এবং সচেতনতার অভাব রয়েছে।
বীমা সম্পর্কে অনীহা বা আস্থাহীনতার পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে। প্রথমত, অনেক সাধারণ মানুষ মনে করেন বীমা একটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। দ্বিতীয়ত, বীমা দাবি নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রিতা ও স্বচ্ছতার অভাবের কারণে অনেক গ্রাহক হতাশ হন। তৃতীয়ত, অসাধু প্রতিষ্ঠান ও এজেন্টদের প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের কারণে জনগণের মধ্যে বীমা সংক্রান্ত নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। এছাড়া, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের অনেকেই বীমাকে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হিসেবে দেখেন এবং এটি গ্রহণে আগ্রহী নন।
জাতীয় বীমা দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো জনগণের মধ্যে বীমার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং এ খাতের বিকাশে নীতি-নির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। তাই ১ মার্চ জাতীয় বীমা দিবস পালিত হয়, যা জনগণের মধ্যে বীমা সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাত এবং বিভিন্ন বীমা কোম্পানির সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই দিবসটি উদযাপিত হয়।
বাংলাদেশে বর্তমানে মোট ৮১টি বীমা কোম্পানি রয়েছে, যার মধ্যে ৩৫টি জীবন বীমা এবং ৪৬টি সাধারণ বীমা কোম্পানি। তবে, কতগুলো কোম্পানি সক্রিয় (স্বচল) এবং কতগুলো নিষ্ক্রিয় (অচল) সে সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট তথ্য বর্তমানে উপলব্ধ নয়। দেশে দুটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বীমা প্রতিষ্ঠান রয়েছে—জীবন বীমা কর্পোরেশন (JBC) ও সাধারণ বীমা কর্পোরেশন (SBC)। এছাড়া, আন্তর্জাতিক কোম্পানির মধ্যে মেটলাইফ (MetLife) এবং লাইফ ইন্স্যুরেন্স কর্পোরেশন (LIC) অব বাংলাদেশ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে বীমা কোম্পানিগুলোর শাখার সংখ্যা ছিল ৭,৮৭৩টি, যা আগের বছরের তুলনায় ১,০০০টিরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। মোট বীমা এজেন্টের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৩০ হাজার, যা এক বছরে ১৩ হাজারেরও বেশি বেড়েছে। দেশে বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ বীমার আওতায় রয়েছে, যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার আনুমানিক ৭.৬৫% (১৭ কোটি হিসাব করলে) বা ৭.২২% (১৮ কোটি হিসাব করলে)। তবে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৮৭৮টি পলিসি তামাদি হয়েছে, যা বীমা খাতের জন্য উদ্বেগজনক।
বাংলাদেশে বীমা গ্রাহকের অভাবের কারণ এবং পূর্ববর্তী বীমা কোম্পানির উধাও হওয়ার ঘটনা।
বাংলাদেশে বীমা কোম্পানির অভাব নেই, তবে বীমা গ্রাহকের অভাব একটি বাস্তবতা। এর পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে:
১. সচেতনতার অভাব: অনেক মানুষ বীমার গুরুত্ব ও সুবিধা সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত নয়। বীমার বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা কম হওয়ায় তারা এটি প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন না।
২. আর্থিক সক্ষমতা: অনেক মানুষের কাছে বীমার প্রিমিয়াম পরিশোধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে সাধারণ মানুষ বীমা নেওয়ার প্রতি আগ্রহ হারান।
৩. বিশ্বাসের অভাব: কিছু মানুষ মনে করেন, বীমা কোম্পানিগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না এবং সময়মতো ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে ব্যর্থ হয়। এ কারণে তারা বীমায় বিনিয়োগ করতে অনাগ্রহী।
৪. সংস্কৃতি ও মানসিকতা: বাংলাদেশে অনেক মানুষ এখনও ভবিষ্যতের সুরক্ষা বা পরিকল্পনা নিয়ে ভাবেন না। অধিকাংশ মানুষ বর্তমানেই সুখী থাকতে চান, যার ফলে বীমার প্রতি আগ্রহ কম।
৫. বীমার বিকল্প অভ্যস্ততা: অনেক মানুষ পরিবার বা বন্ধুবান্ধবের কাছে আর্থিক সহায়তা পাওয়ার আশা রাখে, যদি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি ঘটে। তাদের কাছে বীমা অতিরিক্ত মনে হয়।
৬. বীমার প্রকারের প্রতি অনাগ্রহ: জীবন বীমা বা স্বাস্থ্য বীমার মতো কিছু প্রকারের বীমা সম্পর্কে অনেক মানুষ তেমন আগ্রহী নন। তারা মনে করেন, এসব বীমা শুধু “ধনী” মানুষদের জন্য উপযোগী।
৭. পূর্ববর্তী বীমা কোম্পানির উধাও হওয়া: কিছু বীমা কোম্পানি অতীতে তাদের গ্রাহকদের অর্থ দিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছে, যার ফলে মানুষের মধ্যে বীমা কোম্পানির প্রতি অনাস্থা তৈরি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৯ সালে পিপলস ইনস্যুরেন্স কোম্পানি এবং ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স এর মতো কোম্পানিগুলো তাদের গ্রাহকদের অর্থ নিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। এই ধরনের ঘটনা গ্রাহকদের মধ্যে একধরনের ভয় ও সন্দেহ সৃষ্টি করেছে, যার ফলে বীমার প্রতি তাদের আস্থা কমে গিয়েছে।
উপরোক্ত কারণগুলোর কারণে, বাংলাদেশে বীমা গ্রাহকের সংখ্যা এখনও তুলনামূলকভাবে কম। তবে, সচেতনতা বৃদ্ধি, মানসিকতা পরিবর্তন এবং সরকারের উদ্যোগের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধান হতে পারে।
বীমা দিবসের পটভূমি: জাতীয় বীমা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২০২০ সালে, যা বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। বীমা খাতের দীর্ঘদিনের ইতিহাস ও আর্থিক ব্যবস্থায় এর গুরুত্ব বিবেচনা করে এ দিবসটি নির্ধারণ করা হয়। মূলত, বীমা সেক্টরের উন্নয়ন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই দিবস পালিত হয়, যাতে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হয়।
বীমা খাতের গুরুত্ব: বীমা কেবল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সুরক্ষা প্রদান করে না, এটি দেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। জীবন বীমা, সাধারণ বীমা, স্বাস্থ্য বীমা এবং কৃষি বীমার মাধ্যমে জনগণের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। বিশেষ করে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে বীমা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বীমার মাধ্যমে ব্যক্তি ও পরিবার আর্থিক নিরাপত্তা পায়, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। উন্নত দেশগুলোতে বীমা খাত অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে, যা বাংলাদেশেও বাস্তবায়ন সম্ভব।
বাংলাদেশের বীমা খাতের বর্তমান অবস্থা: বাংলাদেশে বীমা খাত ক্রমবর্ধমানভাবে বিকশিত হলেও, এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। জনগণের মধ্যে বীমা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব, সহজ শর্তে বীমা সুবিধা না পাওয়া এবং কিছু অসাধু প্রতিষ্ঠানের প্রতারণা—এসব কারণে অনেক মানুষ এখনো বীমার প্রতি আগ্রহী নয়।
বর্তমানে বাংলাদেশের মাত্র ৫ শতাংশ জনগণ কোনো না কোনোভাবে বীমার আওতাভুক্ত, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বীমার দাবি প্রক্রিয়াকরণে দীর্ঘসূত্রিতা ও স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে, যা গ্রাহকদের আস্থার সংকট তৈরি করে।
বীমা খাতের চ্যালেঞ্জ ও উন্নয়নের সম্ভাবনা: জাতীয় বীমা দিবস কেবল আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য নয়, বরং এই খাতের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়ানোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ।
বীমা সেবা সহজলভ্য করা: প্রযুক্তিনির্ভর সেবা নিশ্চিত করে গ্রাহকদের জন্য বীমা গ্রহণ ও দাবি নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া সহজতর করতে হবে।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি: বীমা কোম্পানিগুলোকে তাদের নীতিমালা ও কার্যক্রমে আরও স্বচ্ছতা আনতে হবে, যাতে গ্রাহকরা নিশ্চিন্তে বীমা নিতে পারেন।
আইনগত কাঠামো শক্তিশালী করা: প্রতারণামূলক বীমা কার্যক্রম রোধ করতে সরকারকে আরও কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি: স্কুল, কলেজ ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে বীমার উপকারিতা সম্পর্কে প্রচারণা চালাতে হবে।
সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা: বিশেষ করে কৃষক, শ্রমিক ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য সহজ শর্তে বীমা সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
বীমা নীতিমালার আধুনিকায়ন: বর্তমান সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নীতিমালা সংস্কার করতে হবে, যাতে সাধারণ জনগণ সহজেই বীমার সুযোগ নিতে পারে।
বীমায় মানুষের কল্যাণ:
বীমা খাত মানুষের জীবন ও সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে সহায়তা করে। এটি শুধুমাত্র আর্থিক ক্ষতির বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয় না, বরং জাতীয় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত করে।
স্বাস্থ্য বীমা মানুষকে চিকিৎসা ব্যয়ের ভারমুক্ত রাখে, কৃষি বীমা কৃষকদের দুর্যোগকালীন সুরক্ষা দেয় এবং জীবন বীমা পরিবারকে আর্থিক নিশ্চয়তা প্রদান করে। উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও এই খাতকে বিস্তৃত করার মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব।
বীমার সুবিধা কেবল ব্যক্তির জন্যই নয়, বরং এটি সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা পর্যন্ত সবাই বীমার মাধ্যমে নিরাপত্তা পেলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরও ত্বরান্বিত হবে।
জাতীয় বীমা দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে বীমা খাত কেবল ব্যক্তিগত সুরক্ষার বিষয় নয়, বরং এটি জাতীয় অর্থনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। সরকার, বীমা প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই খাতকে আরও শক্তিশালী করা সম্ভব।
বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাকে এগিয়ে নিতে হলে বীমা খাতের প্রতি গুরুত্ব বাড়াতে হবে। জনগণের আস্থা অর্জনের পাশাপাশি, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে এই খাতকে আরও কার্যকর করতে পারলে একটি সুদৃঢ় ও বিশ্বাসযোগ্য বীমা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারব, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত করবে।
লেখক
মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম
সাংবাদিক ও গবেষক
No comments:
Post a Comment