সাইদ সাজু, তানোর থেকে:
কালের বিবর্তনে রাজশাহীর তানোর উপজেলার গ্রামাঞ্চল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর শিশু-কিশোরদের জনপ্রিয় খেলাধুলা। খেলার মাঠ ও পরিবেশের পরিবর্তনের পাশাপাশি কর্মব্যস্ততা ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তারের ফলে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খেলাধুলা বিলুপ্তির পথে। এর ফলে গ্রামের শিশু-কিশোরদের মধ্যে এসব খেলাধুলার চিত্র এখন আর চোখে পড়ে না।
তানোরে ৯০-এর দশকের আগ পর্যন্ত বাড়ির উঠান, খোলা মাঠ ও রাস্তার আনাচে-কানাচে শিশু-কিশোরদের মধ্যে গ্রামীণ খেলাধুলার প্রচলন দেখা যেত। তবে একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই এসব খেলা কমতে থাকে এবং বর্তমানে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন মাঠে-ঘাটে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে যুবক-যুবতীরা হাতে হাতে মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। অধিকাংশ সময় তারা মোবাইল ফোনে ভিডিও গেম, সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন লুডু খেলায় আসক্ত হয়ে পড়েছে।
গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার হারিয়ে যাওয়া তালিকা: গ্রামবাংলার জনপ্রিয় খেলাধুলার মধ্যে রয়েছে—কানামাছি, দাঁড়িয়াবান্ধা, ডাংগুটি, মার্বেল খেলা, ঘোড়াদৌড়, গোল্লাছুট, চারগুটি, লাঠিখেলা, লংজাম্প, সাত পাতা, ফুল টোক্কা, মোরগ যুদ্ধ ও হাডুডু। একসময় গ্রামে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা জনপ্রিয় ছিল, যা বর্তমানে চোখে পড়ে না।
বৃদ্ধদের দৃষ্টিকোণ: তানোর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আধুনিক সভ্যতা ও প্রযুক্তির বিকাশের কারণে এসব ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা হারিয়ে গেছে। অতীতে গ্রামের শিশু-কিশোররা পড়ালেখার পাশাপাশি বিভিন্ন খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকত, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহায়ক ছিল।
প্রযুক্তির প্রভাব: বর্তমানে শিশুরা ঘরের কোণে বসে ইলেকট্রনিক ডিভাইস, ভিডিও গেম ও কার্টুন দেখে সময় কাটায়, ফলে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অতীতে গ্রামের শিশুরা খেলার মাঠে সময় কাটাত, যা তাদের সুস্থ বিনোদন ও সামাজিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত।
খেলার মাঠ সংকট ও মোবাইল আসক্তি: জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে খেলার মাঠের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। অনেক গ্রামবাসী জীবিকার সন্ধানে শহরমুখী হচ্ছে, যেখানে খেলার মাঠের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। তাছাড়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বছরে কয়েকদিন ক্রীড়া অনুষ্ঠান পরিচালনা করলেও সারাবছর কোনো ধরনের খেলাধুলার কার্যক্রম চোখে পড়ে না। এতে শিশুরা খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে মোবাইলের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে, যা কিশোর অপরাধ এবং কিশোর গ্যাং সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছে।
সমাধানের উপায়: গ্রামীণ খেলাধুলাকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে হলে শিশুদের এসব খেলায় আগ্রহী করে তুলতে হবে। শিক্ষক, অভিভাবক ও সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে। বিদ্যালয় ও কমিউনিটি পর্যায়ে নিয়মিত খেলাধুলার আয়োজন করতে হবে। শিশুদের অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং তাদের মাঠমুখী করতে হবে।
গ্রামীণ খেলাধুলা শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি শারীরিক ও মানসিক বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আমাদের ঐতিহ্য রক্ষা করতে এবং সুস্থ প্রজন্ম গড়ে তুলতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
No comments:
Post a Comment