মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম:
বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল ও নদীবাহিত এলাকা মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ, যা দেশের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক খাত। শুঁটকি মাছ এ খাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিক ও আধুনিক পদ্ধতিতে শুঁটকি উৎপাদিত হয়। চট্টগ্রামের বাঁশখালী, কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, সেন্টমার্টিন, সন্দ্বীপ, বরগুনার পাথরঘাটা, ভোলা ও হাতিয়ার মতো এলাকায় শুঁটকি উৎপাদন করা হয়, যা দেশের বাজার ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারেও স্থান করে নিয়েছে।
শুঁটকি মাছ বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের একটি সম্ভাবনাময় খাত হলেও, যথাযথ পরিকল্পনা ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এ শিল্পের বিকাশ সম্ভব নয়। ফলে আমাদের প্রয়োজন সুসংগঠিত শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প গড়ে তোলা, যাতে দেশীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বৈদেশিক বাজারেও প্রতিযোগিতা করা যায়।
শুঁটকির রাজধানী বাঁশখালী:
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলা দেশের অন্যতম প্রধান শুঁটকি উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী হওয়ায় এখানে প্রচুর সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায়, যা শুঁটকি উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত। বাঁশখালীর গণ্ডামারা, খানখানাবাদ, সরল, কাথরিয়া, পুঁইছড়ি ও চাম্বল এলাকায় বিশাল মাঠজুড়ে শুঁটকি উৎপাদন হয়, যা হাজারো মানুষের জীবিকার অন্যতম উৎস।
এখানে লইট্টা, চিংড়ি, রূপচাঁদা, ছুরি, পোয়া, ভোল, ফাইস্যা, কোরালসহ নানা প্রজাতির মাছ দিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হয়। সাধারণত সূর্যের তাপে শুকিয়ে শুঁটকি প্রস্তুত করা হলেও এখন আধুনিক বৈদ্যুতিক ড্রায়ার ব্যবহারের ফলে রাসায়নিকমুক্ত, স্বাস্থ্যসম্মত উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে।
বাঁশখালীর শুঁটকি স্থানীয় বাজার ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারেও রপ্তানি করা হয়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকায় এর চাহিদা বেশি। শুঁটকি শিল্পকে আরও বিকশিত করতে আধুনিক সংরক্ষণাগার, উন্নত প্যাকেজিং ও রাসায়নিকমুক্ত উৎপাদন নিশ্চিত করা জরুরি। সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে বাঁশখালী বাংলাদেশের শুঁটকি রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
কুতুবদিয়া: শুঁটকি শিল্পের আরও এক সম্ভাবনাময় এলাকা:
কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া দ্বীপও শুঁটকি উৎপাদনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এখানকার মৎস্যজীবীরা প্রাকৃতিকভাবে মাছ সংগ্রহ করে শুঁটকি উৎপাদন করেন। সমুদ্রবেষ্টিত হওয়ায় কুতুবদিয়ায় প্রচুর পরিমাণ মাছ ধরা পড়ে, যা স্থানীয়ভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়।
কুতুবদিয়ায় শুঁটকি তৈরির জন্য বিশেষত লইট্টা, ছুরি, চিংড়ি, রূপচাঁদা ও পোয়া মাছ ব্যবহৃত হয়। দ্বীপাঞ্চল হওয়ায় এখানকার শুঁটকি বিশুদ্ধ ও রাসায়নিকমুক্ত থাকে। তবে সঠিক সংরক্ষণের অভাবে অনেক সময় উৎপাদিত শুঁটকি নষ্ট হয়ে যায়।
কুতুবদিয়ার শুঁটকির ব্যবসাকে আরও সম্প্রসারণের জন্য সরকারি হস্তক্ষেপ একান্ত প্রয়োজন। কোল্ড স্টোরেজ, আধুনিক ড্রায়িং সিস্টেম ও উন্নত বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুললে এখানকার শুঁটকি শিল্প আরও সমৃদ্ধ হবে।
দেশের অন্যান্য শুঁটকি উৎপাদন কেন্দ্র:
কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন: কক্সবাজার জেলার মহেশখালী, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনেও বিপুল পরিমাণ শুঁটকি উৎপাদন হয়। বিশেষত সেন্টমার্টিন দ্বীপের শুঁটকি রাসায়নিকমুক্ত হওয়ায় এটি স্থানীয় ও বৈদেশিক বাজারে বেশ জনপ্রিয়।
সন্দ্বীপ (চট্টগ্রাম): সন্দ্বীপের জেলেরা সমুদ্র থেকে মাছ আহরণ করে এবং শুঁটকি তৈরি করেন। এখানকার শুঁটকি চট্টগ্রামের বাজারে সরবরাহ করা হয় এবং কিছু অংশ বিদেশেও রপ্তানি হয়।
পাথরঘাটা (বরগুনা): বরগুনার পাথরঘাটা এলাকায় মৎস্যজীবীরা নদী ও সমুদ্র থেকে প্রচুর মাছ আহরণ এবং শুঁটকি উৎপাদন করেন।
ভোলা ও হাতিয়া (নোয়াখালী): ভোলা ও হাতিয়ার উপকূলীয় এলাকায়ও শুঁটকি উৎপাদন হয়, যা দেশের অন্যতম বৃহৎ শুঁটকি বাজারে পরিণত হয়েছে।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব: শুঁটকি শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বাঁশখালী, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার, সন্দ্বীপ ও অন্যান্য অঞ্চলে প্রতিদিন হাজার হাজার মণ শুঁটকি উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে একটি বড় অংশ স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয় এবং বাকি অংশ বিদেশে রপ্তানি করা হয়।
শুঁটকি রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতি বছর কয়েকশ’ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের শুঁটকির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
শুঁটকি শিল্পের সীমাবদ্ধতা:
১. সংরক্ষণের অভাব: অনেক স্থানে আধুনিক সংরক্ষণাগারের অভাব থাকায় শুঁটকির মান নষ্ট হয়।
২. রাসায়নিক ব্যবহার: কিছু অসাধু ব্যবসায়ী দ্রুত শুকানোর জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করেন, যা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
৩. অপ্রতুল সরকারি সহায়তা: সরকারি অনুদান ও গবেষণার অভাব রয়েছে, যা শিল্পের প্রসার বাধাগ্রস্ত করছে।
৪. শ্রমিকদের নিম্ন মজুরি: নারী ও শিশু শ্রমিকরা কম মজুরিতে কাজ করছেন, যা মানবাধিকার লঙ্ঘন।
৫. আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণের অভাব: ব্র্যান্ডিং ও সঠিক বিপণনের অভাবে শুঁটকির আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারিত হয়নি।
সম্ভাব্য সমাধান ও উত্তোরণের পথ:
১. আধুনিক শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র স্থাপন: রাসায়নিকমুক্ত ও উন্নতমানের শুঁটকি উৎপাদনের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।
২. বৈদেশিক বাজার সম্প্রসারণ: আন্তর্জাতিক বাজারে শুঁটকির প্রচার ও ব্র্যান্ডিং বাড়াতে হবে।
৩. সরকারি সহায়তা: সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, গবেষণা সুবিধা বৃদ্ধি এবং রপ্তানি প্রক্রিয়ায় সহায়তা করা প্রয়োজন।
৪. শ্রমিকদের কল্যাণ: ন্যায্য মজুরি ও শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ৫. স্থানীয় উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা: শুঁটকি শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।
পরিসমাপ্তি:
শুঁটকি শিল্প বাংলাদেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় খাত, যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও কক্সবাজারের কুতুবদিয়া দেশের প্রধান শুঁটকি উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। বাঁশখালীতে বিশাল মাঠজুড়ে শুঁটকি উৎপাদন হয়, যা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে, কুতুবদিয়া দ্বীপের শুঁটকি উৎপাদন তুলনামূলকভাবে প্রাকৃতিক ও রাসায়নিকমুক্ত হওয়ায় এটি স্বাস্থ্যকর এবং ক্রেতাদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়।
তবে, এ শিল্পের আরও বিকাশের জন্য সরকার, বেসরকারি খাত ও স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। বাঁশখালী ও কুতুবদিয়ায় আধুনিক প্রযুক্তির সংযোজন, সংরক্ষণের জন্য কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণ, উন্নতমানের শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র স্থাপন এবং প্রশিক্ষিত শ্রমিক তৈরির উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য রাসায়নিকমুক্ত শুঁটকি উৎপাদনের পাশাপাশি ব্র্যান্ডিং ও বিপণন ব্যবস্থাকে আধুনিক করতে হবে।
বাঁশখালী ও কুতুবদিয়ার পাশাপাশি কক্সবাজার, সন্দ্বীপ, পাথরঘাটা, ভোলা ও হাতিয়ার মতো অঞ্চলেও বিপুল পরিমাণ শুঁটকি উৎপাদিত হয়। এসব অঞ্চলের শুঁটকি শিল্পের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সরকারি-বেসরকারি সমন্বয়ে বৃহৎ আকারের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে এ খাত আরও বিকশিত হবে।
সঠিক পরিকল্পনা, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও নীতিগত সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশ শুঁটকি রপ্তানিতে এশিয়ার শীর্ষস্থানীয় দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। বিশেষ করে বাঁশখালী ও কুতুবদিয়াকে কেন্দ্র করে এই শিল্পের যথাযথ বিকাশ নিশ্চিত করা গেলে এটি দেশের অর্থনীতির জন্য এক বিশাল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে।
লেখক:
মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম
সাংবাদিক ও গবেষক
No comments:
Post a Comment