মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম:
বর্তমান সমাজে যখন অতি সাধারণ মানুষও প্রতিযোগিতায় মত্ত, তখন কিছু ব্যক্তি তাদের মানবিকতা ও সমাজসেবা দিয়ে বিশেষ স্থান অধিকার করে থাকেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন কাজী এমদাদুল হক খোকন। তিনি একজন সমাজসেবক, বইপ্রেমী এবং পাঠাগার সংস্কৃতির প্রবক্তা। তার উদ্যোগের কারণে দেশের বিভিন্ন পাঠাগারে বই বিতরণ একটি আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বইয়ের প্রতি ভালোবাসা এবং সংগ্রহশালা সংস্কৃতির প্রচার:
কাজী এমদাদুল হক খোকন জীবনের মূল লক্ষ্য হিসেবে বই এবং জ্ঞানের প্রসারকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আজ পর্যন্ত তিনি ৫১৬টি পাঠাগারে ৩০,০০০টিরও বেশি বই বিতরণ করেছেন, যার ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ উপকৃত হয়েছেন। তার এই উদ্যোগে তিনি প্রায় ৩০ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন। এই মহৎ কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি শুধু বই বিতরণই করেননি, বরং একটি সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টি করেছেন, যা পাঠাগারের মাধ্যমে জ্ঞান এবং শিক্ষার প্রসারে বড় ভূমিকা পালন করছে।
“আমি টাকা জমাই না, আনন্দ জমাই”
কাজী এমদাদুল হক খোকনের নিজের জীবনের উদ্দেশ্য হিসেবে অর্থ উপার্জন নয়, বরং বইয়ের মাধ্যমে সমাজে আলোর ঝলকানি তৈরি করেছেন। তিনি মনে করেন, পৃথিবী বদলানোর জন্য বইয়ের আলো এবং মানুষে মানুষে শিক্ষার আদান-প্রদান গুরুত্বপূর্ণ। তার একটি পরিচিত উক্তি— “আমি টাকা জমাই না, আনন্দ জমাই”। এটি তার আত্মবিশ্বাস এবং সমাজের জন্য ভালো কিছু করার প্রেরণাকে ফুটিয়ে তোলে। যখন আমাদের অধিকাংশ মানুষ সম্পদ অর্জনে ব্যস্ত, সেখানে তিনি সমাজে আলোকিত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য নিজের পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয় করে যাচ্ছেন।
একনজরে:
কাজী এমদাদুল হক খোকন ১৯৫৬ সালে ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার চাকরির সুবাদে শৈশব ও কৈশোর ময়মনসিংহেই কাটে। তিনি বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং আনন্দ মোহন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর তিনি শরীয়তপুরের ডামুড্যা কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮০ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়ে স্টেনোগ্রাফার হিসেবে যোগ দেন এবং ২০১৫ সালে অবসর গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকার মিরপুরে বসবাস করছেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি দুই সন্তানের জনক।
পাঠাগার সংস্কৃতি এবং অনুপ্রেরণা:
কাজী এমদাদুল হক খোকনের বই বিতরণের উদ্দেশ্য একেবারে নির্দিষ্ট এবং মানবিক। তিনি মনে করেন, যদি বাংলাদেশের প্রত্যেকটি অঞ্চলে পাঠাগার থাকে, তাহলে আমাদের আগামী প্রজন্মের চিন্তা-ধারা আরও প্রগতিশীল হবে। কারণ, বই শুধু মেধারই উন্নতি ঘটায় না, এটি মানুষকে শৃঙ্খলা, দেশপ্রেম এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রতি আরও সচেতন করে তোলে। তার কার্যক্রমের ফলে দেশের পাঠক এবং পাঠাগারের পরিচালকরা তাকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন। তার এ উদ্যোগ শুধু পাঠক সমাজের জন্য নয়, বরং পাঠাগার পরিচালকদের জন্যও এক অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাঠাগার বন্ধু” সম্মাননা:
কাজী এমদাদুল হক খোকনের এ অসামান্য প্রচেষ্টার জন্য ২০২৩ সালে তাকে "পাঠাগার বন্ধু" সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। এই সম্মাননা তার দৃঢ় মানসিকতা, নিষ্ঠা এবং বই বিতরণ কার্যক্রমের জন্য দেওয়া হয়। এটি তার কর্মেরই স্বীকৃতি, যা বইয়ের মাধ্যমে মানুষের জীবন আলোকিত করার উদ্দেশ্যকে আরও শক্তিশালী করেছে।
বই বিতরণে সীমানা অতিক্রম:
কাজী এমদাদুল হক খোকন জানিয়ে দেন যে, তার বই বিতরণের কাজ থেমে থাকবে না। তিনি নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের প্রতিটি উপজেলা এবং ইউনিয়নে পাঠাগার স্থাপন এবং বই বিতরণ কার্যক্রম চালিয়ে যেতে চান। তার লক্ষ্য, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও যাতে সহজেই বই পায় এবং পড়াশোনায় আগ্রহী হয়ে উঠে। তার পরিকল্পনা শুধু বই বিতরণ নয়, বরং পাঠাগারের মাধ্যমে দেশব্যাপী একটি সচেতনতা তৈরি করা, যেখানে সব শ্রেণির মানুষ বই পড়ে নিজেদের আলোকিত করতে পারে।
বই বিতরণের অনুপ্রেরণামূলক গল্প:
কাজী এমদাদুল হক খোকন নিজের জীবনে অনেক ধরনের বাধা অতিক্রম করেছেন, তবে তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং বইয়ের প্রতি ভালোবাসাই তাকে এই লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করেছে। অনেকেই জানেন না যে, তিনি একটি সাধারণ ব্যবসায়ী পরিবার থেকে এসেছেন। কিন্তু তার একটিই লক্ষ্য ছিল— মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া। তিনি নিজে অনেক বই পড়েছেন, এবং পাঠকদের এক নতুন দুনিয়ার সন্ধান দিতে চেয়েছেন।
কোনো পাঠাগারে তিনি যে বইগুলি দান করেছেন, সেখানে বিভিন্ন ধরণের শিক্ষামূলক, সাহিত্যিক, কাব্যিক এবং জীবনের নানা দিক নিয়ে বই রয়েছে। তাঁর দেওয়া বইগুলো এখন সাধারণ পাঠক থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের কাছে অপরিহার্য। তার লক্ষ্য কখনোই শুধু বই বিতরণ ছিল না, বরং তিনি নিশ্চিত করতে চেয়েছেন যে, বইগুলো পাঠকের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।
বেসরকারি পাঠাগার এবং পাঠকদের মেধা বিকাশে কাজী এমদাদুল হক খোকনের ভূমিকা
বাংলাদেশে বেসরকারি পাঠাগারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে। যদিও সরকারী পাঠাগারের তুলনায় এগুলির পরিসর অনেক কম, তবুও বেসরকারি পাঠাগারগুলি সম্প্রতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখন একাধিক বেসরকারি পাঠাগার গড়ে উঠেছে, যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ এবং শিক্ষার্থীরা বই পড়ে মেধা বিকাশের সুযোগ পাচ্ছে।
তবে এখানেই কাজী এমদাদুল হক খোকনের অবদান একেবারে অনন্য। তিনি যখন ৫১৬টি পাঠাগারে বই বিতরণ শুরু করেন, তখন অনেক বেসরকারি পাঠাগার এবং স্থানীয় শিক্ষার্থী যারা শহরের পাঠাগারে যেতে পারেন না, তারা তার বই বিতরণ কার্যক্রমের মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছেন। দেশের ছোট ছোট শহর ও গ্রামে বেসরকারি পাঠাগার গড়ে উঠেছে, এবং সেখানকার পাঠকরা এখন আর শুধু বই পড়ার জন্য নয়, নিজের মেধা বিকাশের জন্যও এসব পাঠাগারে আসছে।
কাজী এমদাদুল হক খোকনের এই কার্যক্রমের ফলে দেশে বেসরকারি পাঠাগার এবং পাঠকের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। স্থানীয় পাঠাগারের মাধ্যমে তারা নানা বিষয় সম্পর্কে জানছে, যেমন— ইতিহাস, সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদি। এই বিষয়গুলো শুধু তাদের জ্ঞানের দিগন্ত খুলে দেয়নি, বরং তাদের চিন্তা-ভাবনাতেও ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। তার বই বিতরণের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের মাঝে মেধার বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
এই বেসরকারি পাঠাগারগুলো স্থানীয় সমাজের মধ্যে একটি শক্তিশালী শিক্ষা ও সংস্কৃতি পরিবেশ তৈরি করতে সহায়তা করছে। সেখানে যে তরুণরা বই পড়ে তাদের মেধার স্ফূর্তির সাথে বড় হচ্ছে, তারা যেন একদিন জাতির অগ্রগতির পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠে। এর ফলে কাজী এমদাদুল হক খোকন শুধু বই বিতরণকারী হিসেবে নয়, একজন সমাজসংস্কারক এবং মেধার বিকাশক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
সমাজের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ অবদান:
আমরা যখন অন্যদের দান-খয়রাতের কাজে বেশি আগ্রহী, তখন কাজী এমদাদুল হক খোকন তার সীমিত সম্পদ দিয়ে এমন কিছু কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন, যা সমাজে দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তন আনতে সক্ষম। তার বই বিতরণের উদ্যোগ সমাজের মধ্যে জ্ঞানের নতুন দিশা দেখিয়েছে। তিনি বিশ্বাস করেন, যখন মানুষের মনের অন্ধকার দূর হবে, তখন সমাজে সত্যিকারের উন্নতি আসবে।
কাজী এমদাদুল হক খোকন যেভাবে দেশব্যাপী পাঠাগারের সংস্কৃতিকে প্রসারিত করতে কাজ করছেন, তা আমাদের জন্য একটি মহৎ উদাহরণ। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার এই উদ্যোগ আমাদের প্রেরণা যোগাচ্ছে। তার কাজের মাধ্যমে পাঠাগারগুলো যেন এক নতুন যুগের সূচনা করেছে, যেখানে মানুষ শুধুমাত্র বই পড়ার মাধ্যমে নয়, বরং নিজেদের জীবনকে সমৃদ্ধ করে তোলার পথ খুঁজে পাচ্ছে।
উপসংহার:
কাজী এমদাদুল হক খোকন আজ আমাদের সমাজে এক নতুন আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছেন। তার বই বিতরণের উদ্যোগ দেশের পাঠাগার সংস্কৃতির উন্নয়ন ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তার কাজের মাধ্যমে আমরা শিখতে পারি যে, সমাজে প্রকৃত পরিবর্তন আনার জন্য একটাই শক্তি- মানবিকতা এবং শিক্ষার বিস্তার। আজকের তরুণরা যদি কাজী এমদাদুল হক খোকনের মতো চিন্তা করতে শুরু করে, তবে আগামীদিনে আমাদের সমাজ হবে আরও সমৃদ্ধ, আলোকিত এবং উন্নত।
লেখক:
মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম:
সাংবাদিক ও
সভাপতি একুশে গণপাঠাগার
বাঁশখালী, চট্টগ্রাম।
No comments:
Post a Comment