মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম:
প্রতারণা মানুষের জীবনে যে ক্ষত সৃষ্টি করে, তা কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এটি সামাজিক নিরাপত্তা, মনস্তাত্ত্বিক শান্তি এবং নাগরিক জীবনের নিরাপত্তাকেও বিপন্ন করে তোলে। সময়ের সঙ্গে প্রতারকদের কৌশলও আরও আধুনিক ও পরিশীলিত হয়ে উঠছে। একসময় অজ্ঞান পার্টি ও মলম পার্টির দৌরাত্ম্য বেশি ছিল, কিন্তু এখন নতুন নতুন ফাঁদ তৈরি হচ্ছে। একদিকে প্রযুক্তির সাহায্যে প্রতারণার দৌরাত্ম্য বেড়েছে, অন্যদিকে সচেতনতার অভাবে সাধারণ মানুষ আরও সহজ শিকার হয়ে উঠছে। এর মধ্যে "ঠিকানা দেখানোর ফাঁদ" একটি নতুন কৌশল, যেখানে প্রতারকরা মানবিকতার সুযোগ নিয়ে ভুক্তভোগী থেকে টাকা, স্বর্ণালংকার, মোবাইলসহ মূল্যবান জিনিস হাতিয়ে নিচ্ছে।
রমজান মাসে প্রতারণার কৌশল আরও বেড়ে গেছে, কারণ এই সময়ে মানুষের মানসিক অবস্থান ও কিছুটা অসাবধানতার সুযোগ নেয় প্রতারকরা। রোজা ও ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন সংস্থার ত্রাণ বিতরণ বা সহায়তা কর্মসূচির সুযোগও নেয়। এর সঙ্গে সাথে অনেকেই ভক্তিভরে সাদকাহ বা জাকাত প্রদান করতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।
প্রতারণার বিভিন্ন কৌশল ও ধরন:
১. ঠিকানা দেখানোর ফাঁদ; এটি একটি পরিশীলিত প্রতারণার কৌশল, যেখানে সাধারণত ব্যস্ত রাস্তায়, গণপরিবহনে বা নির্জন স্থানে প্রতারকরা অসহায় মানুষের অভিনয় করে একটি কাগজ বা মোবাইলে লেখা ঠিকানা দেখায়। তারা সাধারণত এই ধরনের কথাবার্তা বলে-
"ভাই, একটু সাহায্য করেন, আমি এই ঠিকানায় যেতে চাই!"
"আমার আত্মীয় অসুস্থ, জরুরি যেতে হবে, দয়া করে একটু দেখিয়ে দিন!"
"আমি নতুন এসেছি, কিছুই বুঝতে পারছি না, একটু সাহায্য করুন!"
যেই ব্যক্তি সাহায্য করতে যায়, প্রতারক তখন নানা কৌশলে তাকে বিভ্রান্ত করে। কিছু ক্ষেত্রে তারা বিশেষ হিপনোসিস বা মানসিক কৌশল প্রয়োগ করে, যাতে ভুক্তভোগী নিজের অজান্তেই তার মোবাইল, টাকা বা স্বর্ণালংকার তুলে দেয়। কিছু সময় পর ভুক্তভোগী বুঝতে পারে, কিন্তু ততক্ষণে প্রতারক উধাও হয়ে গেছে।
২. অজ্ঞান পার্টির প্রতারণা: এটি একটি পুরনো কৌশল, যা এখনো কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বেশিরভাগ সময়- গণপরিবহন (বাস, ট্রেন, লঞ্চ), রাস্তার পাশে চায়ের দোকান, হাট-বাজারের ব্যস্ত স্থান, এমন জায়গায় অপরিচিত কেউ খাবার, পানীয় বা অন্য কিছু অফার করে, যেখানে চেতনানাশক ওষুধ মেশানো থাকে। ভুক্তভোগী তা গ্রহণ করার পর অজ্ঞান হয়ে যায় এবং প্রতারক তার মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে যায়।
৩. মলম পার্টির হামলা: এটি প্রতারণার আরেকটি ভয়াবহ কৌশল, যেখানে প্রতারকরা বিশেষ ধরনের মলম বা স্প্রে ব্যবহার করে মানুষকে সাময়িকভাবে অন্ধ করে ফেলে বা দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা করে দেয়। এই সুযোগে তারা- চেতনানাশক স্প্রে ব্যবহার করে অন্যদের সঙ্গ থেকে পালিয়ে যায়। মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে সটকে পড়ে। বিশেষভাবে হোটেল, বাজার, বাসস্ট্যান্ড ও ট্রেন স্টেশনে সক্রিয় থাকে।
৪. গণপরিবহনে প্রতারণা ও ডাকাতি: গণপরিবহন বিশেষ করে বাস, সিএনজি, ট্রেনের মধ্যে যাত্রীবেশে ছিনতাইকারী ও ডাকাত চক্র সক্রিয় থাকে। কিছু অপরাধী- যাত্রীবেশে গাড়িতে উঠে এবং সুযোগ বুঝে অন্য যাত্রীদের সর্বস্ব লুটে নেয়। পরিকল্পিতভাবে নির্দিষ্ট এলাকায় গাড়ি থামিয়ে লুট করে। রাতের বেলা ও নির্জন জায়গায় এসব ঘটনা বেশি ঘটে।
৫. হঠাৎ বন্ধুত্ব ও সহানুভূতির নামে প্রতারণা: প্রতারণার আরেকটি কৌশল হলো, অপরিচিত ব্যক্তি হঠাৎ বন্ধু সেজে আলাপ জমিয়ে সহানুভূতি আদায় করে, এবং- "বিপদে পড়েছি, একটু সাহায্য করুন" বলে টাকা ধার নিয়ে পালিয়ে যায়। কেউ হঠাৎ অসুস্থতার নাটক করে সহানুভূতি আদায় করে মূল্যবান জিনিস হাতিয়ে নেয়।
৬. QR কোড ও ডিজিটাল প্রতারণা: প্রতারকরা মোবাইল ব্যাংকিং ও QR কোড স্ক্যান করার মাধ্যমে বড় ধরনের প্রতারণা চালিয়ে থাকে। কিছু কৌশল- মোবাইল ব্যাংকিং-এ ভুলে টাকা পাঠানোর নাটক করে ফেরত চেয়ে প্রতারণা করা হয়। লোভনীয় অনলাইন অফার দিয়ে অগ্রিম টাকা নেওয়ার পর প্রতারকরা গায়েব হয়ে যায়।
৭. রমজান মাসের সুযোগ নেওয়া প্রতারণা: রমজান মাসে বিশেষ কিছু পরিস্থিতি তৈরি হয় যা প্রতারকদের জন্য এক বিশেষ সুযোগ এনে দেয়। উদাহরণস্বরূপ- সাদকাহ ও জাকাত দেওয়ার নামে প্রতারণা: অনেক মানুষ রোজা রেখে সাদকাহ বা জাকাত দিতে চায়, বিশেষ করে ঈদ উৎসবে। এই সময় প্রতারকরা সেসব ব্যক্তি বা পরিবারকে লক্ষ্য করে, যারা তাদের সাহায্যের জন্য প্রস্তুত থাকে। তারা ফেক চ্যারিটি সংগঠন বা রিলিফ ফান্ড তৈরি করে এবং মানুষের বিশ্বাস অর্জন করার চেষ্টা করে।
ত্রাণ বিতরণের নামে প্রতারণা: রমজান মাসে গরীবদের জন্য ত্রাণ বিতরণের নামে কিছু প্রতারক চাঁদা সংগ্রহ করে এবং কোনো কার্যকর বিতরণ না করে সেই টাকা আত্মসাৎ করে।
ঈদ উপহার বিতরণের ফাঁদ: কিছু প্রতারক ঈদের উপহার, সিলভার ও সোনা বিক্রি করার নাম করে সাধারণ মানুষকে আকর্ষণ করে। এর পরে তারা পণ্য দিতে না পারলেও টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়।
প্রতিরোধ ও সতর্কতা: এই ধরনের প্রতারণা থেকে বাঁচতে সচেতনতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিছু নিয়ম অনুসরণ করলে অনেকটা রক্ষা পাওয়া যায়- ১. অপরিচিত কারও দেওয়া খাবার খাবেন না। ২. গণপরিবহনে অপরিচিত কারও সঙ্গে অতিরিক্ত কথা বলবেন না। ৩. যদি সন্দেহজনক কিছু মনে হয়, আশপাশের লোকজনকে জানান ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহায্য নিন। ৪. অজানা QR কোড স্ক্যান করবেন না এবং সন্দেহজনক অনলাইন অফারে লেনদেন করবেন না। ৫. রাতের বেলা নির্জন রাস্তায় চলাচল কমিয়ে দিন এবং প্রয়োজনে বিশ্বস্ত বাহনের ব্যবস্থা করুন। ৬. রোজার সময়, সাদকাহ বা জাকাত দেওয়ার আগে যাচাই করুন যে যে সংস্থায় আপনি সাহায্য দিচ্ছেন সেটি সঠিক ও পরিচিত। ৭. ঈদ উপহার বা ত্রাণের ক্ষেত্রে সাবধানী হন এবং কোনো ধরনের প্রলোভনে পড়ে আর্থিক প্রতারণার শিকার হবেন না।
রাষ্ট্রপক্ষের করণীয়:
এই ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের নির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রের দায়িত্বরত কর্তৃপক্ষের জন্য কিছু করণীয়-
১. আইনগত ব্যবস্থা: - প্রতারণার বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে।- ইন্টারনেট ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রতারণার ক্ষেত্রে আইনগত পদক্ষেপের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।
২. সচেতনতা বৃদ্ধি: -জনগণকে সচেতন করার জন্য জাতীয় প্রচারণা চালানো উচিত, যাতে সাধারণ মানুষ প্রতারণা সম্পর্কে আরও ভালভাবে জানতে পারে।- প্রতারণার বিভিন্ন কৌশল ও প্রতিরোধের বিষয়ে শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকাগুলোতে।
৩. নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নয়ন: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে উন্নত প্রযুক্তি এবং ট্রেনিং প্রদান করে কার্যক্রমের দক্ষতা বাড়াতে হবে। সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে, যাতে শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রতারণার ঘটনা দ্রুত চিহ্নিত ও প্রতিরোধ করা যায়।
৪. গণপরিবহনে নিরাপত্তা ব্যবস্থা: গণপরিবহনে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে, যাতে যাত্রীরা সুরক্ষিত থাকে। নির্দিষ্ট পরিবহন কর্তৃপক্ষকে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রশিক্ষিত কর্মী নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. পুলিশের ভূমিকায় নজরদারি: পুলিশকে সর্বদা গণপরিবহনে এবং ব্যস্ত রাস্তায় নজরদারি জোরদার করতে হবে, যাতে প্রতারণা ঠেকানো যায়। বিশেষ দল গঠন করে প্রতারকদের ধরতে নিয়মিত টহল ও অনুসন্ধান চালাতে হবে।
সচেতনতাই প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি: প্রতারণা থেকে রক্ষা পেতে আমাদের উচিত সর্বদা সতর্ক থাকা এবং এই বিষয়ে আরও সচেতন হওয়া। বিশেষ করে ডিজিটাল যুগে মানুষের প্রতারণার ধরন দ্রুত পাল্টাচ্ছে, তাই আমাদের মনোযোগী ও দায়িত্বশীল হতে হবে। সচেতনতা এবং আইনগত পদক্ষেপ একসঙ্গে কার্যকরী হলে, আমরা এই ধরনের প্রতারণা থেকে নিরাপদ থাকতে পারব।
সতর্ক থাকুন, নিরাপদ থাকুন!
লেখক:
মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম
সংবাদিক ও কলামিস্ট
No comments:
Post a Comment