মানুষ বনাম বন্য হাতি: সংঘাতের কারণ, পরিণতি ও প্রতিরোধের উপায় - একুশে মিডিয়া একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ গণমাধ্যম হিসেবে সংবাদ পরিবেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা

ক্লিক করুন

Breaking News

  

Home Top Ad

নিউজের উপরে বিজ্ঞাপন

Wednesday, 5 March 2025

demo-image

মানুষ বনাম বন্য হাতি: সংঘাতের কারণ, পরিণতি ও প্রতিরোধের উপায়

মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম:

Human%20vs.%20Wild%20Elephants

বাংলাদেশের পার্বত্য বনাঞ্চলসংলগ্ন এলাকায় মানুষ বন্য হাতির সংঘাত ক্রমশ মারাত্মক আকার ধারণ করছে। একসময় যেখানে হাতির দল অবাধে চলাফেরা করত, সেই বনাঞ্চল আজ মানুষের বসতি, কৃষি কার্যক্রম অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ফলে খাদ্যের সন্ধানে হাতির দল গ্রাম বা কৃষিজমিতে ঢুকে পড়ছে এবং এর ফলে প্রাণহানি, সম্পদহানি পরিবেশগত ক্ষতি প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি, হাতির আতঙ্কে অনেক কৃষক তাদের জমিতে চাষ করা বন্ধ করে দিয়েছেন, ফলে কৃষির উৎপাদন কমে যাচ্ছে এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।

বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে বন্য হাতির আক্রমণে মানুষের মৃত্যু এখন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, শেরপুর ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত জেলার মধ্যে রয়েছে বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা সুনামগঞ্জ। বিশেষ করে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, বাঁশখালী; কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ, মহেশখালী; বান্দরবানের লামা, আলীকদম, থানচি; রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল; খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, লক্ষীছড়ি; শেরপুরের নালিতাবাড়ি; ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলাগুলোতে হাতির আক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি। বনাঞ্চল সংকুচিত হওয়া, হাতির খাবারের অভাব এবং মানুষের ক্রমবর্ধমান বসতি সম্প্রসারণের কারণে সংঘাত দিন দিন বাড়ছে।

হাতি-মানুষ সংঘাতের কারণ:

প্রকৃতিতে বন্য প্রাণীদের টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ থাকতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং অনিয়ন্ত্রিত বন ধ্বংসের ফলে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। বন্য হাতির খাদ্যসংকট সৃষ্টি হলে তারা গ্রামে ঢুকে পড়ে, ফসল নষ্ট করে এবং কখনো কখনো মানববসতিতেও হামলা চালায়।

. বন উজাড় কৃষিজমির বিস্তৃতি: কৃষিকাজের জন্য বনভূমি কেটে ফেলা হচ্ছে, যার ফলে হাতির চলাচলের করিডোর নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

. রোহিঙ্গা শিবির হাতির আবাসস্থল দখল: কক্সবাজার টেকনাফ অঞ্চলে রোহিঙ্গা শিবির স্থাপনের ফলে হাতির প্রাকৃতিক চলাচলের পথ বাধাগ্রস্ত হয়েছে, ফলে সংঘর্ষ বেড়েছে।

. খাদ্যের অভাব: বনাঞ্চলে খাবারের সংকট দেখা দিলে হাতির দল খাবারের সন্ধানে গ্রামাঞ্চলে চলে আসে।

. মানুষের প্রতিরোধ: অনেক সময় গ্রামের মানুষ হাতির আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে গিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, যা উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর।

. জনবসতি স্থাপনা ধ্বংস: হাতির আক্রমণে শুধু মানুষের জীবনহানিই ঘটছে না, প্রচুর ঘরবাড়ি, স্কুল, বাজার, রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ অন্যান্য স্থাপনাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

. ফসল গাছগাছালির ক্ষতি: ফলন্ত ফসল, কলাগাছ, বাঁশঝাড়, সুপারি নারকেল গাছের মতো চাষাবাদের ওপর নির্ভরশীল কৃষকরাও ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ছেন।

. চাষাবাদে বাধা: হাতির আতঙ্কে অনেক কৃষক তাদের জমিতে চাষ করা বন্ধ করে দিয়েছেন, ফলে কৃষির উৎপাদন কমে যাচ্ছে এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।

. মানব-হাতি সংঘর্ষ বৃদ্ধির প্রবণতা: প্রতি বছর সংঘর্ষের পরিমাণ বাড়ছে, এবং বন্য হাতির আক্রমণে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সংঘাতের ভয়াবহতা:

প্রতি বছর বাংলাদেশে বন্য হাতির আক্রমণে গড়ে ৩০-৪০ জন মানুষ নিহত এবং শতাধিক মানুষ আহত হন। এছাড়া, হাতির দল বসতবাড়ি কৃষিজমিতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, যার ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি, দেশের বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে হাতির করিডোর সংকুচিত হয়ে পড়ছে, যা ভবিষ্যতে সংঘর্ষ আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।

রাষ্ট্রীয় জনগণের ক্ষতি:

হাতি-মানুষ সংঘাত শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

. অর্থনৈতিক ক্ষতি: প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার ফসল, গৃহস্থালি সামগ্রী, অবকাঠামো বাণিজ্যিক বাগান হাতির আক্রমণে ধ্বংস হয়। সরকারকে পুনর্নির্মাণ সহায়তার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয়।

. পর্যটন খাতে প্রভাব: পার্বত্য অঞ্চলে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ পর্যটনের ওপর এই সংঘাত নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা রাষ্ট্রের রাজস্ব আয় কমিয়ে দেয়।

. পরিবেশগত ক্ষতি: হাতির করিডোর সংকুচিত হওয়ায় বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে বন জলবায়ুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

. জনগণের জীবনমানের অবনতি: নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেক পরিবার তাদের আদি বসতভিটা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে, যা সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার সৃষ্টি করছে।

. রাষ্ট্রীয় বন সংরক্ষণ নীতি আইন প্রয়োগে দুর্বলতা: হাতি-মানুষ সংঘাত রোধে যথাযথ নীতি আইনি কাঠামোর কার্যকর প্রয়োগ দরকার।

সমাধানের উপায়:

এই সংঘাত নিরসনে প্রয়োজন সুসমন্বিত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। সরকার, বন বিভাগ, পরিবেশবিদ এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

. হাতির করিডোর সংরক্ষণ: হাতির চলাচলের ঐতিহ্যগত করিডোরগুলো সংরক্ষণ পুনরুদ্ধার করা দরকার।

. বিকল্প খাদ্যের ব্যবস্থা: হাতির খাদ্যসংকট কমাতে বিশেষ বনাঞ্চল তৈরি করা যেতে পারে, যেখানে হাতির জন্য পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা থাকবে।

. মানব-হাতি সংঘাত প্রশমন প্রযুক্তি: সৌরচালিত বৈদ্যুতিক বেড়া, মৌমাছির ছাদ, এবং অন্যান্য নন-প্রাণঘাতী পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে।

. জনসচেতনতা বৃদ্ধি: স্থানীয় জনগণকে সচেতন করা দরকার যেন তারা হাতিকে উসকানি না দেয় এবং সংঘাত এড়ানোর কৌশল শিখে নেয়।

. আইন প্রয়োগ: হাতি শিকার বন উজাড়ের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করা প্রয়োজন।

. ক্ষতিপূরণ সহায়তা: ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য আর্থিক সহায়তা এবং ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার, যাতে তারা নতুন করে চাষাবাদ শুরু করতে পারেন।

. গবেষণা পরিকল্পনা: হাতি-মানুষ সংঘাত কমানোর জন্য নতুন প্রযুক্তি, গবেষণা পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনার মাধ্যমে টেকসই সমাধান খোঁজা উচিত।

উপসংহার:

বন্য হাতি মানুষের সংঘাত শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়; এটি একটি বৈশ্বিক সংকট। তবে আমাদের দেশে বনাঞ্চল ধ্বংস, অবৈধ দখল অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে সমস্যা ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। যদি এখনই টেকসই পরিকল্পনা কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে সংঘাত আরও মারাত্মক আকার ধারণ করবে। মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে যদি হাতির আবাসস্থল ধ্বংস করা হয়, তাহলে প্রকৃতির ভারসাম্য বিনষ্ট হবে, যা দীর্ঘমেয়াদে আমাদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। তাই উন্নয়ন প্রকৃতি সংরক্ষণের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে মানুষ বন্যপ্রাণী উভয়েই নিরাপদে সহাবস্থান করতে পারবে, যা পরিবেশ জীববৈচিত্র্যের জন্যও ইতিবাচক হবে।

 

Pic-%20Syedul%20Alam

লেখক-

মোহাম্মদ ছৈয়দুল আলম

সাংবাদিক ও কলাম লেখক

ই-মেইল: sayad.ds2012@gmail.com

No comments:

Post a Comment

নিউজের নীচে। বিজ্ঞাপনের জন্য খালী আছে

Pages

Contact Form

Name

Email *

Message *